Connect with us

উপন্যাস

অনুরাধা – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

Avatar

Published

on

এক

কন্যার বিবাহযোগ্য বয়সের সম্বন্ধে যত মিথ্যা চালানো যায় চালাইয়াও সীমানা ডিঙাইয়াছে। বিবাহের আশাও শেষ হইয়াছে।—ওমা, সে কি কথা! হইতে আরম্ভ করিয়া চোখ টিপিয়া কন্যার ছেলেমেয়ের সংখ্যা জিজ্ঞাসা করিয়াও এখন আর কেহ রস পায় না, সমাজে এ রসিকতাও বাহুল্য হইয়াছে। এমনি দশা অনুরাধার। অথচ ঘটনা সে-যুগের নয়, নিতান্তই আধুনিককালের। এমন দিনেও যে কেবলমাত্র গণ-পণ, ঠিকুজি-কোষ্ঠী ও কুলশীলের যাচাই-বাছাই করিতে এমনটা ঘটিল—অনুরাধার বয়স তেইশ পার হইয়া গেল, বর জুটিল না—এ কথা সহজে বিশ্বাস হয় না। তবু ঘটনা সত্য।

সকালে এই গল্পই চলিতেছিল আজ জমিদারের কাছারিতে। নূতন জমিদারের নাম হরিহর ঘোষাল, কলিকাতাবাসী—তাঁর ছোটছেলে বিজয় আসিয়াছে গ্রামে।

বিজয় মুখের চুরুটটা নামাইয়া রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি বললে, গগন চাটুয্যের বোন? বাড়ি ছাড়বে না?

যে লোকটা খবর আনিয়াছিল সে কহিল, বললে—যা বলবার ছোটবাবু এলে তাঁকেই বলব।

বিজয় ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল, তার বলবার আছে কি! এর মানে তাদের বার করে দিতে আমাকে যেতে হবে নিজে। লোক দিয়ে হবে না?

লোকটা চুপ করিয়া রহিল। বিজয় পুনশ্চ কহিল, বলবার তাঁর কিছুই নেই বিনোদ, কিছুই আমি শুনব না। তবু তাঁরি জন্যে আমাকেই যেতে হবে তাঁর কাছে—তিনি নিজে এসে দুঃখ জানাতে পারবেন না?

বিনোদ কহিল, আমি তাও বলেছিলাম। অনুরাধা বললে, আমিও ভদ্র-গেরস্থঘরের মেয়ে বিনোদদা, বাড়ি ছেড়ে যদি বার হতেই হয় তাঁকে জানিয়ে একেবারেই বার হয়ে যাব, বার বার বাইরে আসতে পারব না।

কি নাম বললে হে, অনুরাধা? নামের ত দেখি ভারী চটক—তাই বুঝি এখনো অহঙ্কার ঘুচল না?

আজ্ঞে না।

বিনোদ গ্রামের লোক, অনুরাধাদের দুর্দশার ইতিহাস সে-ই বলিতেছিল।কিন্তু অনতিপূর্ব ইতিহাসেরও একটা অতিপূর্ব ইতিহাস থাকে—সেইটা বলি।

এই গ্রামখানির নাম গণেশপুর, একদিন ইহা অনুরাধাদেরই ছিল, বছর-পাঁচেক হইল হাতবদল হইয়াছে। সম্পত্তির মুনাফা হাজার-দুয়ের বেশি নয়, কিন্তু অনুরাধার পিতা অমর চাটুয্যের চালচলন ছিল বিশ হাজারের মত। অতএব ঋণের দায়ে ভদ্রাসন পর্যন্ত গেল ডিক্রি হইয়া। ডিক্রি হইল, কিন্তু জারি হইল না; মহাজন ভয়ে থামিয়া রহিল। চট্টোপাধ্যায় মহাশয় ছিলেন যেমন বড় কুলীন, তেমনি ছিল প্রচণ্ড তাঁর জপতপ ক্রিয়াকর্মের খ্যাতি। তলা-ফুটা সংসার-তরণী অপব্যয়ের লোনাজলে কানায়-কানায় পূর্ণ হইল, কিন্তু ডুবিল না। হিন্দু-গোঁড়ামির পরিস্ফীত পালে সর্বসাধারণের ভক্তিশ্রদ্ধার ঝোড়ো হাওয়া এই নিমজ্জিত-প্রায় নৌকাখানিকে ঠেলিতে ঠেলিতে দিল অমর চাটুয্যের আয়ুষ্কালের সীমানা উত্তীর্ণ করিয়া। অতএব চাটুয্যের জীবদ্দশাটা একপ্রকার ভালই কাটিল। তিনি মরিলেনও ঘটা করিয়া, শ্রাদ্ধশান্তিও নির্বাহিত হইল ঘটা করিয়া, কিন্তু সম্পত্তির পরিসমাপ্তি ঘটিলও এইখানে। এতদিন নাকটুকু মাত্র ভাসাইয়া যে তরণী কোনমতে নিঃশ্বাস টানিতেছিল, এইবার ‘বাবুদের বাড়ি’র সমস্ত মর্যাদা লইয়া অতলে তলাইতে আর কালবিলম্ব করিল না।

পিতার মৃত্যুতে পুত্র গগন পাইল এক জরাজীর্ণ ডিক্রি-করা পৈতৃক বাস্তুভিটা, আকণ্ঠ ঋণ-ভারগ্রস্ত গ্রাম্য-সম্পত্তি, গোটাকয়েক গরু-ছাগল-কুকুর-বিড়াল এবং ঘাড়ে পড়িল পিতার দ্বিতীয় পক্ষের অনূঢ়া কন্যা অনুরাধা।

এইবার পাত্র জুটিল গ্রামেরই এক ভদ্রব্যক্তি। গোটা পাঁচ-ছয় ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতি রাখিয়া বছর-দুই হইল তাহার স্ত্রী মরিয়াছে, সে বিবাহ করিতে চায়।

অনুরাধা বলিল, দাদা, কপালে রাজপুত্র ত জুটল না, তুমি এইখানেই আমার বিয়ে দাও। লোকটার টাকাকড়ি আছে, তবু দুটো খেতে-পরতে পাব।

গগন আশ্চর্য হইয়া কহিল, সে কি কথা! ত্রিলোচন গাঙ্গুলির পয়সা আছে মানি, কিন্তু ওর ঠাকুরদাদা কুল ভেঙ্গে সতীপুরের চক্রবর্তীদের ঘরে বিয়ে করেছিল জানিস? ওদের আছে কি?

বোন বলিল, আর কিছু না থাক টাকা আছে। কুল নিয়ে উপোস করার চেয়ে দু-মুঠো ভাত-ডাল পাওয়া ভালো দাদা।

গগন মাথা নাড়িয়া বলিল, সে হয় না,—হবার নয়।

কেন নয় বল ত? বাবা ও-সব মানতেন, কিন্তু তোমার ত কোন বালাই নেই।

এখানে বলা আবশ্যক পিতার গোঁড়ামি পুত্রের ছিল না। মদ্য-মাংস ও আরও একটা আনুষঙ্গিক ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত পুরুষ। পত্নী-বিয়োগের পরে ভিন্নপল্লীর কে একটি নীচজাতীয়া স্ত্রীলোক আজও তাহার অভাব মোচন করিতেছে এ কথা সকলেই জানে।

গগন ইঙ্গিতটা বুঝিল, গর্জিয়া বলিল, আমার বাজে গোঁড়ামি নেই, কিন্তু কন্যাগত কুলের শাস্ত্রাচার কি তোর জন্যে জলাঞ্জলি দিয়ে চোদ্দপুরুষ নরকে ডোবাব? কৃষ্ণের সন্তান, স্বভাব-কুলীন আমরা—যা যা, এমন নোংরা কথা আর কখনো মুখে আনিস নে। এই বলিয়া সে রাগ-করিয়া চলিয়া গেল, ত্রিলোচন গাঙ্গুলির প্রস্তাবটা এইখানেই চাপা পড়িল।

গগন হরিহর ঘোষালকে ধরিয়া পড়িল—কুলীন ব্রাক্ষ্মণকে ঋণমুক্ত করিতে হইবে। কলিকাতায় কাঠের ব্যবসায়ে হরিহর লক্ষপতি ধনী। একদিন তাঁহার মাতুলালয় ছিল এই গ্রামে, বাল্যে বাবুদের বহু সুদিন তিনি চোখে দেখিয়াছেন, বহু কাজেকর্মে পেট ভরিয়া লুচিমণ্ডা আহার করিয়া গিয়াছেন, টাকাটা তাঁহার পক্ষে বেশি নয়, তিনি সম্মত হইলেন। চাটুয্যেদের সমস্ত ঋণ পরিশোধ করিয়া হরিহর গণেশপুর ক্রয় করিলেন, কুণ্ডুদের ডিক্রির টাকা দিয়া ভদ্রাসন ফিরাইয়া লইলেন, কেবল মৌখিক শর্ত এই রহিল যে, বাহিরের গোটা দুই-তিন ঘর কাছারির জন্য ছাড়িয়া দিয়া গগন অন্দরের দিকটায় যেমন বাস করিতেছে তেমনিই করিবে।

তালুক খরিদ হইল, কিন্তু প্রজারা মানিতে চাহিল না। সম্পত্তি ক্ষুদ্র, আদায় সামান্য, সুতরাং বড় রকমের কোন ব্যবস্থা করা চলে না; কিন্তু, অল্পের মধ্যেই কি কৌশল যে গগন খেলিতে লাগিল, হরিহরের পক্ষের কোন কর্মচারী গিয়াই গণেশপুরে টিকিতে পারিল না। অবশেষে গগনের নিজেরই প্রস্তাবে সে নিজেই নিযুক্ত হইল কর্মচারী; অর্থাৎ ভূতপূর্ব ভূস্বামী সাজিলেন বর্তমান জমিদারদের গোমস্তা। মহাল শাসনে আসিল, হরিহর হাঁফ ফেলিয়া বাঁচিলেন, কিন্তু আদায়ের দিক দিয়া রহিল যথাপূর্বস্তথা পরঃ।

এক পয়সা তহবিলে জমা পড়িল না। এমনিভাবে গোলেমালে আরও বছর-দুই কাটিল, তার পরে হঠাৎ একদিন খবর আসিল—গোমস্তাবাবু গগন চাটুয্যেকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না। সদর হইতে হরিহরের লোক আসিয়া খোঁজখবর তত্ত্বতল্লাস করিয়া জানিল আদায় যাহা হইবার হইয়াছে, সমস্তই গগন আত্মসাৎ করিয়া সম্প্রতি গা-ঢাকা দিয়াছে। পুলিশে ডায়রি, আদালতে নালিশ, বাড়ি খানাতল্লাশী প্রয়োজনীয় যাহা কিছু সবই হইল, কিন্তু না টাকা, না গগন কাহারও সন্ধান মিলিল না। গগনের ভগিনী অনুরাধা ও দূর-সম্পর্কের একটি ছেলেমানুষ ভাগিনেয় বাটীতে থাকিত, পুলিশের লোকে তাহাকে বিধিমত কষামাজা ও নাড়াচাড়া দিল, কিন্তু কোন তথ্যই বাহির হইল না।

বিজয় বিলাত-ফেরত। তাহার পুনঃ পুনঃ একজামিন ফেল করার রসদ যোগাইতে হরিহরকে অনেক টাকা গণিতে হইয়াছে। পাস করিতে সে পারে নাই, কিন্তু বিজ্ঞতার ফলস্বরূপ মেজাজ গরম করিয়া বছর-দুই পূর্বে দেশে ফিরিয়াছে। বিজয় বলে, বিলাতে পাস-ফেলের কোন প্রভেদ নাই। বই মুখস্থ করিয়া পাশ করিতে গাধাতেও পারে, সে উদ্দেশ্য থাকিলে সে এখানে বসিয়াই বই মুখস্থ করিত, য়ুরোপে যাইত না। বাড়ি আসিয়া সে পিতার কাঠের ব্যবসায়ের কাল্পনিক দুরবস্থায় শঙ্কা প্রকাশ করিল এবং এই নড়বড়ে, পড়ো-পড়ো কারবার ম্যানেজ করিতে আত্মনিয়োগ করিল। কর্মচারী মহলে ইতিমধ্যেই নাম হইয়াছে,—কেরানীরা তাহাকে বাঘের মত ভয় করে। কাজের চাপে যখন নিঃশ্বাস ফেলিবার অবকাশ নাই এমনি সময়ে আসিয়া পৌঁছিল গণেশপুরের বিবরণ। সে কহিল, এ ত জানা কথা, বাবা যা করবেন তা এইরকম হতে বাধ্য। কিন্তু উপায় নাই, অবহেলা করিলে চলবে না—তাহাকে সরেজমিনে নিজে গিয়া একটি বিহিত করিতেই হইবে। এইজন্যই তাহার গণেশপুরে আসা। কিন্তু এই ছোট কাজে বেশিদিন পল্লীগ্রামে থাকা চলে না, যত শীঘ্র সম্ভব একটা ব্যবস্থা করিয়া তাহাকে কলিকাতায় ফিরিতে হইবে। সমস্তই যে একা তাহারি মাথায়। বড়ভাই অজয় এটর্নি। অত্যন্ত স্বার্থপর, নিজের অফিস ও স্ত্রী-পুত্র লইয়াই ব্যস্ত, সংসারের সকল বিষয়েই অন্ধ, শুধু ভাগাভাগির ব্যাপারে তাহার একজোড়া চক্ষু দশজোড়ার কাজ করে। স্ত্রী প্রভাময়ী কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট, বাড়ির লোকজনের সংবাদ লওয়া ত দূরের কথা, শ্বশুর-শাশুড়ী বাঁচিয়া আছে কি না খবর লইবারও সে বেশী অবকাশ পায় না। গোটা পাঁচ-ছয় ঘর লইয়া বাটীর যে অংশে তাহার মহল সেখানে পরিজনবর্গের গতিবিধি সঙ্কুচিত, তাহার ঝি-চাকর আলাদা—উড়ে বেহারা আছে। শুধু বুড়া কর্তার অত্যন্ত নিষেধ থাকায় আজও মুসলমান বাবুর্চি নিযুক্ত হইতে পারে নাই। এই অভাবটা প্রভাকে পীড়া দেয়। আশা আছে শ্বশুর মরিলেই ইহার প্রতিকার হইবে। দেবর বিজয়ের প্রতি তাহার চিরদিনই অবজ্ঞা, শুধু বিলাত প্রত্যাবর্তনের পরে মনোভাবের কিঞ্চিৎ পরিবর্তন দেখা দিয়াছে। দুই-চারিদিন নিমন্ত্রণ
করিয়া নিজে রাঁধিয়া ডিনার খাওয়াইয়াছে, সেখানে ছোটবোন অনিতার সহিত বিজয়ের পরিচয় হইয়াছে। সে এবার বি এ পরীক্ষায় অনার্সে পাস করিয়া এম এ পড়ার আয়োজন করিতেছে।

বিজয় বিপত্নীক। স্ত্রী মরার পরেই সে বিলাত যায়। সেখানে কি করিয়াছে না করিয়াছে, খোঁজ করিবার আবশ্যক নাই; কিন্তু ফিরিয়া পর্যন্ত অনেকদিন দেখা গিয়াছে স্ত্রী-জাতি সম্বন্ধে তাহার মেজাজটা কিছু রুক্ষ। মা বিবাহের কথা বলায় সে জোর গলায় আপত্তি জানাইয়া তাঁহাকে নিরস্ত করিয়াছিল। তখন হইতে অদ্যাবধি প্রসঙ্গটা গোলেমালেই কাটিয়াছে।

গণেশপুরে আসিয়া একজন প্রজার সদরের গোটা-দুই ঘর লইয়া বিজয় নূতন কাছারি ফাঁদিয়া বসিয়াছে। সেরেস্তার কাগজপত্র গগনের গৃহে যাহা পাওয়া গিয়াছে জোর করিয়া এখানে আনা হইয়াছে এবং এখন চেষ্টা চলিতেছে তাহার ভগিনী অনুরাধা এবং দূর-সম্পর্কের সেই ভাগিনেয় ছোঁড়াটাকে বহিষ্কৃত করার। বিনোদ ঘোষের সহিত এইমাত্র সেই পরামর্শই হইতেছিল।

কলিকাতা হইতে আসিবার বিজয় সময়ে তাহার সাত-আট বছরের ছেলে কুমারকে সঙ্গে আনিয়াছে।

পল্লীগ্রামের সাপ-খোপ বিছা-ব্যাঙের ভয়ে মা আপত্তি করিলে বিজয় বলিয়াছিল, মা, তোমার বড়বৌয়ের প্রসাদে তোমার নাড়ুগোপাল নাতি-নাতনীর অভাব নেই, কিন্তু এটাকে আর তা ক’রো না। আপদে-বিপদে মানুষ হতে দাও।

শুনা যায়, বিলাতের সাহেবরাও নাকি ঠিক এমনিই বলিয়া থাকে। কিন্তু সাহেবদের কথা ছাড়াও এ-ক্ষেত্রে একটু গোপন ব্যাপার আছে। বিজয় যখন বিলাতে, তখন মাতৃহীন ছেলেটার একটু অযত্নেই দিন গিয়াছে। তাহার ভগ্নস্বাস্থ্য পিতামহী অধিকাংশ সময়েই থাকেন শয্যাগত, সুতরাং যথেষ্ট বিত্ত-বিভব থাকা সত্ত্বেও কুমারকে দেখিবার কেহ ছিল না, কাজেই দুঃখে-কষ্টেই সে বেচারা বড় হইয়াছে। বিলাত হইতে বাড়ি ফিরিয়া এই খবরটা বিজয়ের কানে গিয়াছিল।

গণেশপুরে আসিবার কালে বৌদিদি হঠাৎ দরদ দেখাইয়া বলিয়াছিল, ছেলেটা সঙ্গে যাচ্চে ঠাকুরপো, পাড়াগাঁ জায়গা একটু সাবধানে থেকো। কবে ফিরবে?

যত শীঘ্র পারি।

শুনেচি আমাদের সেখানে একটা বড় বাড়ি আছে—বাবা কিনেছিলেন।

কিনেছিলেন, কিন্তু কেনা মানেই থাকা নয় বৌদি। বাড়ি আছে কিন্তু দখল নেই।

কিন্তু তুমি যখন নিজে যাচ্ছো ঠাকুরপো, তখন দখলে আসতেও দেরি হবে না।

আশা ত তাই করি।

দখলে এলে কিন্তু একটা খবর দিও।

কেন বৌদি?

ইহার উত্তরে প্রভা বলিয়াছিল, এই ত কাছে, পাড়াগাঁ কখনো চোখে দেখিনি, গিয়ে একদিন দেখে আসব। অনুরও কলেজ বন্ধ, সেও হয়ত সঙ্গে যেতে চাইবে।

এ প্রস্তাবে বিজয় অত্যন্ত পুলকিত হইয়া বলিয়াছিল, আমি দখল নিয়েই তোমাকে খবর পাঠাব বৌদি, তখন কিন্তু না বলতে পাবে না। বোনটিকে সঙ্গে নেওয়া চাই।

অনিতা যুবতী, সে দেখিতে সুশ্রী ও অনার্সে বি. এ. পাস করিয়াছে। সাধারণ স্ত্রীজাতির বিরুদ্ধে বিজয়ের বাহ্যিক অবজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও রমণী-বিশেষের একাধারে এতগুলা গুণ সে মনে মনে যে তুচ্ছ করে তাহা নয়। সেখানে শান্ত পল্লীর নির্জন প্রান্তরে কখনো,—কখনো বা প্রাচীন বৃক্ষচ্ছায়াচ্ছন্ন সঙ্কীর্ণ গ্রাম্য পথের একান্তে সহসা মুখোমুখি আসিয়া পড়ার সম্ভাবনা তাহার মনের মধ্যে সেদিন বার বার করিয়া দোল দিয়া গিয়াছিল।

দুই

বিজয়ের পরনে খাঁটি সাহেবি পোশাক, মাথায় শোলার টুপি, মুখে কড়া চুরুট, পকেটে রিভলবার, চেরির ছড়ি ঘুরাইতে ঘুরাইতে বাবুদের বাড়ির সদর-বাটীতে আসিয়া প্রবেশ করিল। সঙ্গে মস্ত লাঠি-হাতে দু’জন হিন্দুস্থানী দরোয়ান, অনেকগুলি অনুগত প্রজা, বিনোদ ঘোষ ও পুত্র কুমার। সম্পত্তি দখল করার ব্যাপারে যদিচ হাঙ্গামার ভয় আছে, তথাপি ছেলেকে নাড়ুগোপাল করার পরিবর্তে মজবুত করিয়া গড়িয়া তোলার এ হইল বড় শিক্ষা—তাই ছেলেও আসিয়াছে সঙ্গে। বিনোদ কিন্তু বরাবর ভরসা দিয়াছে যে, অনুরাধা একাকী স্ত্রীলোক, কোনমতেই জোরে পারিবে না। তবু রিভলবার যখন আছে তখন সঙ্গে লওয়াই ভালো।

বিজয় বলিল, মেয়েটা শুনেচি ভারী বজ্জাত, লোক জড়ো করে তুলতে পারে। ও-ই ত গগন চাটুয্যের পরামর্শদাতা। স্বভাব-চরিত্রও মন্দ।

বিনোদ বলিল, আজ্ঞে তা ত শুনিনি।

আমি শুনেচি।

কোথাও কেহ নাই, শূন্য প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া বিজয় চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। বাবুদের বাড়ি বলা যায় বটে। সম্মুখে পূজার দালান এখনো ভাঙ্গে নাই, কিন্তু জীর্ণতার শেষ সীমায় পৌঁছিয়াছে। একপাশে সারি সারি বসিবার ঘর ও বৈঠকখানা—দশা একই। পায়রা, চড়াই ও চামচিকায় স্থায়ী আশ্রয় বানাইয়াছে।

দরোয়ান হাঁকিল, কোই হ্যায়?

তাহার সম্ভ্রমহীন চড়া-গলার চিৎকারে বিনোদ ঘোষ ও অন্যান্য অনেকেই যেন লজ্জায় সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। বিনোদ বলিল, রাধুদিদিকে আমি গিয়ে খবর দিয়ে আসচি বাবু। বলিয়া ভিতরে চলিয়া গেল।

তাহার কণ্ঠস্বর ও বলার ভঙ্গীতে বুঝা গেল, আজও এ-বাড়ির অমর্যাদা করিতে তাহাদের বাধে।

অনুরাধা রাঁধিতেছিল; বিনোদ গিয়া সবিনয়ে জানাইল, দিদি, ছোটবাবু বাইরে এসেছেন।

সে এ দুর্দৈব প্রত্যহই আশঙ্কা করিতেছিল। হাত ধুইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, সন্তোষকে ডাকিয়া কহিল, বাইরে একটা সতরঞ্চি পেতে দিয়ে এসো বাবা, বল গে মাসিমা আসচেন। বিনোদকে বলিল, আমার বেশী দেরি হবে না—বাবু রাগ করেন না যেন বিনোদদা, আমার হয়ে তাঁকে বসতে বল গে।

বিনোদ লজ্জিত মুখে কহিল, কি করব দিদি, আমরা গরীব প্রজা, জমিদার হুকুম করলে না বলতে পারিনে, কাজেই—

সে আমি বুঝি বিনোদদা।

বিনোদ চলিয়া গেল, বাহিরে সতরঞ্চি পাতা হইল, কিন্তু কেহ তাহাতে বসিল না। বিজয় ছড়ি ঘুরাইয়া পায়চারি করিতে করিতে চুরুট টানিতে লাগিল।

মিনিট-পাঁচেক পরে সন্তোষ বাহিরে আসিয়া ইঙ্গিতে দ্বারের প্রতি চাহিয়া সভয়ে কহিল, মাসীমা এসেছেন।

বিজয় থমকিয়া দাঁড়াইল। ভদ্রঘরের কন্যা, তাহাকে কি বলিয়া সম্বোধন করা উচিত, সে দ্বিধায় পড়িল। কিন্তু দৌর্বল্য প্রকাশ পাইলে চলিবে না, অতএব পুরুষকণ্ঠে অন্তরালবর্তিনীর উদ্দেশ্যে কহিল, এ বাড়ি আমাদের তুমি জানো?

উত্তর আসিল, জানি।

তবে ছেড়ে দিচ্চো না কেন?

অনুরাধা তেমনি আড়ালে দাঁড়াইয়া বোনপোর জবানি বক্তব্য বলিবার চেষ্টা করিল। কিন্তু ছেলেটা চালাক-চৌকস নয়, নূতন জমিদারের কড়া মেজাজের জনশ্রুতিও তাহার কানে পৌঁছিয়াছে, ভয়ে ভয়ে কেবলি থতমত খাইতে লাগিল, একটা কথাও সুস্পষ্ট হইল না।

বিজয় মিনিট পাঁচ-ছয় ধৈর্য ধরিয়া বুঝিবার চেষ্টা করিল, তার পরে হঠাৎ একটা ধমক দিয়া বলিয়া উঠিল, তোমার মাসীর বলার কিছু থাকলে সামনে এসে বলুক। নষ্ট করার সময় আমার নেই—আমি বাঘ-ভালুকও নয়, তাকে খেয়ে ফেলব না। বাড়ি ছাড়বে না কেন বলুক।

অনুরাধা বাহিরে আসিল না, কিন্তু কথা কহিল। সন্তোষের মুখে নয়, নিজের মুখে স্পষ্ট করিয়া বলিল, বাড়ি ছাড়ার কথা ছিল না। আপনার বাবা হরিহরবাবু বলেছিলেন, এর ভেতরের অংশে আমরা বাস করতে পারি।

কোন লেখাপড়া আছে?

না নেই। কিন্তু তিনি এখনো জীবিত, তাঁকে জিজ্ঞেসা করলেই জানতে পারবেন।

জিজ্ঞেসা করার গরজ আমার নেই। এই যদি শর্ত তাঁর কাছে লিখে নাওনি কেন?

দাদা বোধ হয় প্রয়োজন মনে করেন নি। তাঁর মুখের কথার চেয়ে লিখে নেওয়া বড় হবে এ হয়ত দাদার মনে হয়নি।

এ কথার সঙ্গত উত্তর বিজয় খুঁজিয়া পাইল না, চুপ করিয়া রহিল। কিন্তু পরক্ষণেই জবাব আসিল ভিতর হইতেই।

অনুরাধা কহিল, কিন্তু দাদা নিজের শর্ত ভঙ্গ করায় এখন সকল শর্তই ভেঙ্গে গেছে। এ-বাড়িতে থাকবার অধিকার আর আমাদের নেই। কিন্তু আমি একা স্ত্রীলোক, আর এই অনাথ ছেলেটি। ওর মা-বাপ নেই, আমি মানুষ করচি, আমাদের এই দুর্দশায় দয়া করে দু’দিন থাকতে না দিলে একলা হঠাৎ কোথায় যাই এই আমার ভাবনা।

বিজয় বলিল, এ জবাব কি আমার দেবার? তোমার দাদা কোথায়?

মেয়েটি বলিল, আমি জানিনে তিনি কোথায়। কিন্তু আপনার সঙ্গে যে এতদিন দেখা করতে পারিনি সে শুধু এই ভয়ে, পাছে আপনি বিরক্ত হন। এই বলিয়া ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বোধ করি সে নিজেকে সামলাইয়া লইল, কহিল, আপনি মনিব, আপনার কাছে কিছুই লুকোব না। অকপটে আমাদের বিপদের কথা জানালুম, নইলে একটা দিনও জোর করে এ-বাড়িতে বাস করার দাবী আমি করিনে। এই ক’টা দিন বাদে আমরা আপনিই চলে যাব।

তাহার কণ্ঠস্বরে বাহিরে হইতেও বুঝা গেল মেয়েটির চোখ দিয়া জল পড়িতেছে। বিজয় দুঃখিত হইল, মনে মনে খুশীও হইল। সে ভাবিয়াছিল ইহাকে বে-দখল করিতে না জানি কত সময় ও কত হাঙ্গামাই পোহাইতে হইবে, কিন্তু কিছুই হইল না, সে অশ্রুজলে শুধু দয়া ভিক্ষা চাহিল। তাহার পকেটের পিস্তল এবং দরোয়ানদের লাঠিসোঁটা তাহাকে গোপনে তিরস্কার করিল, কিন্তু দুর্বলতা প্রকাশ করাও চলে না। বলিল, থাকতে দিতে আপত্তি ছিল না, কিন্তু বাড়িতে আমার নিজের বড় দরকার। যেখানে আছি সেখানে খুব অসুবিধে, তা ছাড়া আমাদের বাড়ির মেয়েরা নিজের একবার দেখতে আসতে চান।

মেয়েটি বলিল, বেশ ত আসুন না। বাইরের ঘরগুলোতে আপনি স্বচ্ছন্দে থাকতে পারেন, এবং ভিতরে দোতলায় অনেকগুলো ঘর। মেয়েরা অনায়াসে থাকতে পারবেন কোন কষ্ট হবে না। আর বিদেশে তাঁদের ত লোকের আবশ্যক, আমি অনেক কাজ করে দিতে পারব।

এবার বিজয় সলজ্জে আপত্তি করিয়া কহিল, না না, সে কি কখনো হতে পারে! তাঁদের সঙ্গে লোকজন সবাই আসবে, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। কিন্তু ভিতরের ঘরগুলো কি আমি একবার দেখতে পারি?

উত্তর হইল, কেন পারবেন না, এ ত আপনারই বাড়ি। আসুন।

ভিতরে ঢুকিয়া বিজয় পলকের জন্য তাহার সমস্ত মুখখানি দেখিতে পাইল। মাথায় কাপড় আছে কিন্তু ঘোমটায় ঢাকা নয়। পরনে একখানি আধময়লা আটপৌরে কাপড়, গায়ে গহনা নাই, শুধু দু’হাতে কয়েকগাছি সোনার চুড়ি—সাবেক কালের।আড়াল হইতে তাহার অশ্রু-সিঞ্চিত কণ্ঠস্বর বিজয়ের কানে বড় মধুর ঠেকিয়াছিল, ভাবিয়াছিল, মানুষটিও হয়ত এমনি হইবে। বিশেষতঃ, দরিদ্র হইলেও সে ত বড়ঘরের মেয়ে, কিন্তু দেখিতে পাইল তাহার প্রত্যাশার সঙ্গে কিছুই মিলিল না। রঙ ফরসা নয়, মাজা শ্যাম। বরঞ্চ একটু কালোর দিকেই। সাধারণ পল্লীগ্রামের মেয়ে আরও পাঁচজনকে যেমন দেখিতে তেমনি। শরীর কৃশ কিন্তু বেশ দৃঢ় বলিয়াই মনে হয়। শুইয়া বসিয়া ইহার আলস্যে দিন কাটে নাই তাহাতে সন্দেহ হয় না। শুধু বিশেষত্ব চোখে পড়িল ইহার ললাটে—একেবারে আশ্চর্য নিখুঁত গঠন।

মেয়েটি কহিল, বিনোদদা, বাবুকে তুমি সব দেখিয়ে আনো, আমি রান্নাঘরে আছি।

তুমি সঙ্গে যাবে না রাধুদিদি?

না।

উপরে উঠিয়া বিজয় ঘুরিয়া ঘুরিয়া সমস্ত দেখিল। ঘর অনেকগুলি। সাবেক কালের অনেক আসবাব এখনো ঘরে ঘরে, কতক ভাঙ্গিয়াছে, কতক ভাঙ্গার পথে। এখন তাহাদের মূল্য সামান্যই, কিন্তু একদিন ছিল। সদরবাটীর মত এ-ঘরগুলিও জরাজীর্ণ, হাড়পাঁজরা বার করা। দারিদ্র্যের দাগ সকল বস্তুতেই গাঢ় হইয়া পড়িয়াছে।

বিজয় নীচে নামিয়া আসিলে অনুরাধা রান্নাঘরের দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। দরিদ্র ও দুর্দশাপন্ন হইলেও ভদ্রঘরের মেয়ে, এবার তুমি বলিয়া সম্বোধন করিতে বিজয়ের লজ্জা করিল, কহিল, আপনি কতদিন এ-বাড়িতে থাকতে চান?

ঠিক করে ত এখুনি বলতে পারিনে, যে-ক’টা দিন দয়া করে আপনি থাকতে দেন।

দিন-কয়েক পারি, কিন্তু বেশিদিন ত পারব না। তখন কোথায় যাবেন?

সেই চিন্তাই ত দিনরাত করি।

লোকে বলে, আপনি গগন চাটুয্যের ঠিকানা জানেন।

তারা আর কি বলে?

বিজয় এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিল না। অনুরাধা কহিল, জানিনে তা আপনাকে আগেই বলেচি, কিন্তু জানলেও নিজের ভাইকে ধরিয়ে দেব এই কি আপনি আদেশ করেন?

তাহার কণ্ঠস্বরে তিরস্কার মাখানো। বিজয় ভারী অপ্রতিভ হইল, বুঝিল আভিজাত্যের চিহ্ন ইহার মন হইতে এখনো বিলুপ্ত হয় নাই। বলিল, না, সে কাজ আপনাকে আমি করতে বলিনে, পারি নিজেই খুঁজে বার করব, তাকে পালাতে দেব না। কিন্তু এতকাল ধরে সে যে আমাদের এই সর্বনাশ করছিল—এও কি আপনি জানতে পারেন নি বলতে চান?

কোন উত্তর আসিল না।

বিজয় বলিতে লাগিল, সংসারে কৃতজ্ঞতা বলে ত একটা কথা আছে। নিজের ভাইকে এটুকু পরামর্শ কি কোনদিন দিতে পারেন নি? আমার বাবা নিতান্ত নিরীহ মানুষ, আপনাদের বংশের প্রতি তাঁর অত্যন্ত মমতা, বিশ্বাসও ছিল তেমনি বড়, তাই গগনকেই দিয়েছিলেন সমস্ত সঁপে, এ কি তারই প্রতিফল? কিন্তু নিশ্চিত জানবেন আমি দেশে থাকলে কখনও এমন ঘটতে পারত না।

অনুরাধা নীরব। কোন কথারই জবাব পাইল না দেখিয়া বিজয় মনে মনে আবার উষ্ণ হইয়া উঠিল। তাহার যেটুকু করুণা জন্মিয়াছিল সমস্ত উবিয়া গেল, কঠিন হইয়া বলিল, সবাই জানে আমি কড়া লোক, বাজে দয়ামায়া করিনে, দোষ করে আমার হাতে কেউ রেহাই পায় না, দাদার সঙ্গে দেখা হলে এটুকু অন্ততঃ তাকে জানিয়ে দেবেন।

অনুরাধা তেমনি মৌন হইয়া রহিল।

বিজয় কহিল, আজ সমস্ত বাড়িটার আমি দখল নিলাম। বাইরের ঘরগুলো পরিষ্কার হলে দিন-দুই পরে এখানে চলে আসব, মেয়েরা আসবেন তার পরে। আপনি নীচের একটা ঘরে থাকুন যে ক’দিন না যেতে পারেন, কিন্তু কোন জিনিসপত্র সরাবার চেষ্টা করবেন না।

কুমার বলিল, বাবা, তেষ্টা পেয়েচে আমি জল খাব।

এখানে জল পাব কোথায়?

অনুরাধা হাত নাড়িয়া ইশারায় তাহাকে কাছে ডাকিল, রান্নাঘরের ভিতরে আনিয়া কহিল, ডাব আছে খাবে বাবা?

হাঁ খাব।

সন্তোষ কাটিয়া দিতে ছেলেটা পেট ভরিয়া শাঁস ও জল খাইয়া বাহিরে আসিল, কহিল, বাবা তুমি খাবে? খুব মিষ্টি।

না।

খাও না বাবা অনেক আছে। সব তো আমাদের।

কথাটা কিছুই নয়, তথাপি এতগুলি লোকের মধ্যে ছেলের মুখ হইতে কথাটা শুনিয়া হঠাৎ কেমন তাহার লজ্জা করিয়া উঠিল, কহিল, না না খাব না, তুই চলে আয়।

তিন

বাবুদের বাড়ির সদর অধিকার করিয়া বিজয় চাপিয়া বসিল। গোটা-দুই তাহার নিজের জন্য, বাকিগুলা হইল কাছারি। বিনোদ ঘোষ কোন একসময়ে জমিদারী সেরেস্তায় চাকরি করিয়াছিল, সেই সুপারিশে নিযুক্ত হইল নূতন গোমস্তা। কিন্তু ঝঞ্ঝাট মিটিল না। প্রধান কারণ, গগন চাটুয্যে টাকা আদায় করিয়া হাতে হাতে রসিদ লিখিয়া দেওয়া অপমানকর জ্ঞান করিত, যেহেতু তাহাতে অবিশ্বাসের গন্ধ আছে—সেটা চাটুয্যে-বংশের অগৌরব। সুতরাং তাহার অন্তর্ধানের পরে প্রজারা বিপদে পড়িয়াছে, মৌখিক সাক্ষ্য প্রমাণ লইয়া নিত্যই হাজির হইতেছে, কাঁদা-কাটা করিতেছে,—কে কত দিয়াছে কত বাকী রাখিয়াছে নিরূপণ করা একটা কষ্টসাধ্য জটিল ব্যাপার হইয়া উঠিয়াছে। বিজয় যত শীঘ্র কলিকাতায় ফিরিবে মনে করিয়াছিল তাহা হইল না, একদিন দুইদিন করিয়া দশ-বারোদিন কাটিয়া গেল। এদিকে ছেলেটা হইয়াছে সন্তোষের বন্ধু, বয়সে তিন-চার বছরের ছোট, সামাজিক ও সাংসারিক ব্যবধানও অত্যন্ত বৃহৎ, কিন্তু অন্য সঙ্গীর অভাবে সে মিশিয়া গেছে ইহারই সঙ্গে। ইহারই সঙ্গে থাকে বাটীর ভিতরে, ঘুরিয়া বেড়ায় বাগানে বাগানে নদীর ধারে—কাঁচা আম কুড়াইয়া পাখির বাসা খুঁজিয়া। খায় অধিকাংশ সময়ে সন্তোষের মাসীর কাছে, ডাকে তাহারি দেখাদেখি মাসীমা বলিয়া। বাহিরে টাকাকড়ি হিসাব-পত্র লইয়া বিজয় বিব্রত, সকল সময়ে ছেলের খোঁজ করিতে পারে না, যখন পারে তখন তাহার দেখা মিলে না। হঠাৎ কোনদিন হয়ত বকাঝকা করে, রাগ করিয়া কাছে বসাইয়া রাখে, কিন্তু ছাড়া পাইলেই ছেলেটা দৌড় মারে মাসিমার রান্নাঘরে। সন্তোষের পাশে বসিয়া খায় দুপুরবেলা ভাত, বিকালে তাহারি সঙ্গে ভাগাভাগি করিয়া লয় রুটি ও নারিকেল-নাড়ু।

সেদিন বিকালে লোকজন তখনো কেহ আসিয়া পৌঁছায় নাই, বিজয় চা খাইয়া চুরুট ধরাইয়া ভাবিল নদীর ধারটা খানিক ঘুরিয়া আসে। হঠাৎ মনে পড়িল সমস্তদিন ছেলেটার দেখা নাই। পুরাতন চাকরটা দাঁড়াইয়া ছিল, জিজ্ঞাসা করিল, কুমার কোথায় রে?

সে ইঙ্গিতে দেখাইয়া কহিল, বাড়ির মধ্যে।

ভাত খেয়েছিল?

না।

জোর করে ধরে এনে খাওয়াস নে কেন?

এখানে খেতে চায় না, রাগ করে ছড়িয়ে ফেলে দেয়।

কাল থেকে আমার সঙ্গে ওর খাবার জায়গা করে দিস, এই বলিয়া কি ভাবিয়া আর সে বেড়াইতে গেল না, সোজা ভিতরে গিয়া প্রবেশ করিল। সুদীর্ঘ প্রাঙ্গণের অপর প্রান্ত হইতে পুত্রের কণ্ঠস্বর কানে গেল—মাসিমা, আর একখানা রুটি আর দুটো নারকেল-নাড়ু—শিগগির!

যাহাকে আদেশ করা হইল সে কহিল, নেবে আয় না বাবা, তোদের মত আমি কি গাছে উঠতে পারি?

জবাব হইল—পারবে মাসিমা, কিছু শক্ত নয়। এই মোটা ডালটায় পা দিয়ে ওই ছোট ডালটা ধরে এক টান দিলেই উঠে পড়বে।

বিজয় কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। রান্নাঘরের সম্মুখে একটা বড় আম গাছ, তাহার দু’দিকের দুই মোটা ডালে বসিয়া কুমার ও বন্ধু সন্তোষ। পা ঝুলাইয়া গুঁড়িতে ঠেস দিয়া উভয়ের ভোজনকার্য চলিতেছে, তাহাকে দেখিয়া দু’জনেই ত্রস্ত হইয়া উঠিল। অনুরাধা রান্নাঘরের দ্বারের অন্তরালে সরিয়া দাঁড়াইল।

বিজয় জিজ্ঞাসা করিল, ওই কি ওদের খাবার জায়গা নাকি?

কেহ উত্তর দিল না। বিজয় অন্তরালবর্তিনীকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, আপনার ওপর দেখচি ও খুব অত্যাচার করচে।

এবার অনুরাধা মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল, বলিল, হাঁ।

তবু ত প্রশ্রয় কম দিচ্চেন না,—কেন দিচ্চেন?

না দিলে আরও বেশি উপদ্রব করবে সেই ভয়ে।

কিন্তু বাড়িতে ত এ-রকম উৎপাত করে না শুনেচি।

হয়ত করে না। ওর মা নেই, ঠাকুরমা প্রায়ই শয্যাগত, বাপ থাকেন বাইরে কাজকর্ম নিয়ে, উৎপাত করবে কার ওপর?

বিজয় ইহা জানে না তাহা নয়, তথাপি ছেলেটার যে মা নাই এই কথাটা পরের মুখে শুনিয়া তাহার ক্লেশ বোধ হইল, কহিল, আপনি দেখচি অনেক বিষয় জানেন, কে বললে আপনাকে? কুমার?

অনুরাধা ধীরে ধীরে কহিল, বলবার বয়েস ওর হয়নি, তবু ওর মুখ থেকেই শুনতে পাই। দুপুরবেলা রোদ্দুরে ওদের আমি বেরোতে দিইনে, তবু ফাঁকি দিয়ে পালায়। যেদিন পারে না আমার কাছে শুয়ে বাড়ির গল্প করে।

বিজয় তাহার মুখ দেখিতে পাইল না, কিন্তু সেই প্রথম দিনটির মত আজো সেই কণ্ঠস্বর বড় মধুর লাগিল; তাই বলার জন্য নয়, কেবল শোনার জন্যই কহিল, এবার বাড়ি ফিরে গিয়ে ওর মুশকিল হবে।

কেন?

তার কারণ উপদ্রব জিনিসটা নেশার মত। না পেলে কষ্ট হয়, শরীর আইঢাই করে। কিন্তু সেখানে ওর নেশার খোরাক যোগাবে কে? দু’দিনেই ত পালাই পালাই করবে।

অনুরাধা আস্তে আস্তে বলিল, না, ভুলে যাবে—কুমার নেবে এসো বাবা, রুটি নিয়ে যাও।

কুমার বাটি হাতে করিয়া নামিয়া আসিল এবং মাসির হাত হইতে আরও কয়েকটা রুটি ও নারিকেল-নাড়ু লইয়া তাঁহারই গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া আহার করিতে লাগিল, গাছে উঠিল না। বিজয় চাহিয়া দেখিল, সেগুলি তাহাদের ধনীগৃহের তুলনায় পদগৌরবে যেমনি হীন হউক, সত্যকার মর্যাদায় কিছুমাত্র খাটো নয়। কেন যে ছেলেটা মাসীর রান্নাঘরের প্রতি এত আসক্ত বিজয় তাহার কারণ বুঝিল। সে ভাবিয়া আসিয়াছিল কুমারের লুব্ধতায় তাঁহার অহেতুক ও অতিরিক্ত ব্যয়ের কথা তুলিয়া প্রচলিত শিষ্টবাক্যে পুত্রের জন্য সঙ্কোচ প্রকাশ করিবে এবং করিতেও যাইতেছিল, কিন্তু বাধা পড়িল। কুমার বলিল, মাসীমা, কালকের মত চন্দ্রপুলি করতে আজও যে তোমাকে বলেছিলুম, করোনি কেন?

মাসীমা কহিল, অন্যায় হয়ে গেছে বাবা, সাবধান হইনি। সমস্ত দুধ বেড়ালে উলটে ফেলে দিয়েছে—কাল আর এমন হবে না।

কোন বিড়ালটা বল ত? সাদাটা?

সেইটেই বোধ হয়, বলিয়া অনুরাধা হাত দিয়া তাহার মাথায় এলোমেলো চুলগুলি সোজা করিয়া দিতে লাগিল।

বিজয় কহিল, উৎপাত ত দেখচি ক্রমশঃ জুলুমে গিয়ে ঠেকেচে।

কুমার বলিল, খাবার জল কৈ?

ঐ যাঃ, ভুলে গেছি বাবা, এনে দিচ্চি।

তুমি সবই ভুলে যাও মাসীমা। তোমার কিচ্ছু মনে থাকে না।

বিজয় বলিল, আপনার বকুনি খাওয়াই উচিত। ত্রুটি পদে পদে।

হাঁ, বলিয়া অনুরাধা হাসিয়া ফেলিল। অসতর্কতাবশত: এ-হাসি বিজয়ের চোখে পড়িল। পুত্রের অবৈধ আচরণের ক্ষমাভিক্ষা করা আর হইল না, পাছে তাহার ভদ্রবাক্য অভদ্র ব্যঙ্গের মত শুনায়, পাছে এই মেয়েটির মনে হয় তাহার দৈন্য ও দুর্দশাকে সে কটাক্ষ করিতেছে।

পরদিন দুপুরবেলা অনুরাধা কুমার ও সন্তোষকে ভাত বাড়িয়া দিয়া তরকারি পরিবেশন করিতেছে, তাহার মাথার কাপড় খোলা, গায়ের বস্ত্র অসংবৃত, অকস্মাৎ দ্বারপ্রান্তে মানুষের ছায়া পড়িতে অনুরাধা ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল, ছোটবাবু। শশব্যস্তে মাথায় আঁচল তুলিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

বিজয় বলিল, একটা অত্যন্ত জরুরি পরামর্শের জন্য আপনার কাছে এলুম। বিনোদ ঘোষ গ্রামের লোক, অনেকদিন দেখচেন, ও কি-রকম লোক বলতে পারেন? ওকে গণেশপুরের নতুন গোমস্তা বাহাল করেচি, সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যায় কিনা—আপনার কি মনে হয়?

বিনোদ এক সপ্তাহের অধিক কাজ করিতেছে, যথাসাধ্য ভালো কাজই করিতেছে, কোন গোলযোগ ঘটায় নাই, সহসা হন্তদন্ত হইয়া তাহার চরিত্রের খোঁজতল্লাশ করিবার এখনই কি প্রয়োজন হইল অনুরাধা ভাবিয়া পাইল না; মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, বিনোদদা কি কিছু করেছেন?

এখনো কিছু করেনি, কিন্তু সতর্ক হওয়া ত প্রয়োজন।

তাঁকে ভালো লোক বলেই ত জানি।

সত্যি জানেন, না নিন্দে করবেন না বলেই ভালো বলচেন?

আমার ভাল-মন্দ বলার কি কিছু দাম আছে?

আছে বৈ কি। সে যে আপনাকেই প্রামাণ্য সাক্ষী মেনে বসেছে।

অনুরাধা একটু ভাবিয়া বলিল, উনি ভালো লোকই বটে। শুধু একটু চোখ রাখবেন। নিজের অবহেলায় ভালো লোকও মন্দ হয়ে ওঠা অসম্ভব নয়।

বিজয় কহিল, সত্যিই তাই। কারণ, অপরাধের হেতু খুঁজতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই অবাক হতে হয়।

ছেলেকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, তোর ভাগ্য ভালো যে হঠাৎ এক মাসীমা পেয়ে গেছিস, নইলে এই বন-বাদাড়ের দেশে অর্ধেক দিন না খেয়ে কাটাতে হতো।

অনুরাধা আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, আপনার কি এখানে খাবার কষ্ট হচ্চে?

বিজয় হাসিয়া বলিল, না, এমনিই বললুম। চিরকাল বিদেশে বিদেশে কাটিয়েছি, খাবার কষ্ট বড় গ্রাহ্য করিনে। বলিয়া চলিয়া গেল। অনুরাধা জানালার ফাঁক দিয়া দেখিল তাহার স্নান পর্যন্ত এখনো হয় নাই।

চার

এ বাড়িতে আসিয়া একটা পুরাতন আরাম-কেদারা যোগাড় হইয়াছিল, বিকালের দিকে তাহারি দুই হাতলে পা ছড়াইয়া দিয়া বিজয় চোখ বুজিয়া চুরুট টানিতেছিল, কানে গেল—বাবুমশাই? চোখ মেলিয়া দেখিল অনতিদূরে দাঁড়াইয়া এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাহাকে সসম্মানে সম্বোধন করিতেছে। বিজয় উঠিয়া বসিল। ভদ্রলোকের বয়স ষাটের উপরে গিয়াছে, কিন্তু দিব্য গোলগাল বেঁটেখাটো শক্ত-সমর্থ দেহ। গোঁফ পাকিয়া সাদা হইয়াছে, কিন্তু মাথায় প্রশস্ত টাকের আশেপাশের চুলগুলি ভ্রমর-কৃষ্ণ। সম্মুখের গোটা-কয়েক ছাড়া দাঁতগুলি প্রায় সমস্তই বিদ্যমান। গায়ে তসরের কোট, গরদের চাদর, পায়ে চীনা-বাড়ির বার্নিশ-করা জুতা, ঘড়ির সোনার চেন হইতে সোনা বাঁধানো বাঘের নখ ঝুলিতেছে। পল্লীঅঞ্চলে ভদ্রলোকটিকে অবস্থাপন্ন বলিয়াই মনে হয়। পাশে একটা ভাঙ্গা টুলের উপর বিজয়ের চুরুটের সাজ-সরঞ্জাম থাকিত, সরাইয়া লইয়া তাঁহাকে বসিতে দিল।

ভদ্রলোক বসিয়া বলিলেন, নমস্কার বাবু।

বিজয় কহিল, নমস্কার।

আগন্তুক বলিলেন, আপনারা গ্রামের জমিদার, মহাশয়ের পিতাঠাকুর হচ্ছেন কৃতী ব্যক্তি—লক্ষপতি। নাম করলে সুপ্রভাত হয়—আপনি তাঁরই সুসন্তান। স্ত্রীলোকটিকে দয়া না করলে সে যে ভেসে যায়।

কে স্ত্রীলোক? কত টাকা বাকি?

ভদ্রলোক বলিলেন, টাকার ব্যাপার নয়। স্ত্রীলোকটি হচ্চে ঈশ্বর অমর চাটুয্যের কন্যা— প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি— গগন চাটুয্যের বৈমাত্র ভগিনী। এ তার পৈতৃক গৃহ। সে থাকবে না চলে যাবে,—তার ব্যবস্থাও হয়েছে—কিন্তু আপনি যে তারে ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দিচ্চেন, এ কি মশায়ের কর্তব্য?

এই অশিক্ষিত বৃদ্ধের প্রতি ক্রোধ করা চলে না বিজয় মনে মনে বুঝিল, কিন্তু কথা বলার ধরনে জ্বলিয়া গেল। কহিল, আমার কর্তব্য আমি বুঝিব, কিন্তু আপনি কে যে তাঁর হয়ে ওকালতি করতে এসেছেন?

বৃদ্ধ বলিলেন, আমার নাম ত্রিলোচন গাঙ্গুলি, পাশের গ্রাম মসজিদপুরে বাড়ি— সবাই চেনে। আপনার বাপ-মায়ের আশীর্বাদে আমার কাছে গিয়ে হাত পাততে হয় না এমন লোক এদিকে কম। বিশ্বাস না হয় বিনোদ ঘোষকে জিজ্ঞাসা করবেন।

বিজয় কহিল, আমার হাত পাতবার দরকার হলে মশায়ের খোঁজ নেব, কিন্তু যাঁর ওকালতি করতে এসেছেন তাঁর আপনি কে জানতে পারি কি?

ভদ্রলোক রসিকতার ছলে ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, কুটুম্ব। বোশেখের এই ক’টা দিন বাদে আমি ওঁকে বিবাহ করব।

বিজয় চকিত হইয়া কহিল, আপনি বিবাহ করবেন অনুরাধাকে?

আজ্ঞে হাঁ। আমার স্থির সঙ্কল্প। জ্যৈষ্ঠ ছাড়া আর দিন নেই, নইলে এই মাসেই শুভকর্ম সমাধা হয়ে যেত, থাকতে দেবার কথা আপনাকে আমার বলতেও হ’তো না।

বিজয় কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া প্রশ্ন করিল, বিয়ের ঘটকালি করলে কে? গগন চাটুয্যে?

বৃদ্ধ রোষ-কষায়িত চক্ষে কহিলেন, সে ত ফেরারী আসামী মশাই— প্রজাদের সর্বনাশ করে চম্পট দিয়েচে। এতদিন সেই ত বাধা দিচ্ছিল, নইলে অঘ্রানেই বিবাহ হয়ে যেত। বলে, স্বভাব-কুলীন, আমরা কৃষ্ণের সন্তান—বংশজের ঘরে বোন দেব না। এই ছিল তার বুলি। এখন সে গুমোর রইল কোথায়? বংশজের ঘরে যেচে আসতে হ’লো যে! এখনকার দিনে কুল কে খোঁজে মশাই? টাকাই কুল, টাকাই মান, টাকাই সব,—বলুন ঠিক কিনা?

বিজয় বলিল, হাঁ ঠিক। অনুরাধা স্বীকার করেছেন?

ভদ্রলোক সদম্ভে জানুতে চপেটাঘাত করিয়া কহিলেন, স্বীকার? বলচেন কি মশাই, যাচা-যাচি! শহর থেকে এসে আপনি একটা তাড়া লাগাতেই দু’চোখে অন্ধকার—যাই মা তারা দাঁড়াই কোথা! নইলে আমার ত মতলব ঘুরে গিয়েছিল। ছেলেদের অমত, বৌমাদের অমত, মেয়ে-জামাইরা সব বেঁকে দাঁড়িয়েছিল,—আমিও ভেবেছিলুম দূর হোক গে, দু’সংসার তো হ’লো, আর না। কিন্তু লোক দিয়ে নিজে ডেকে পাঠিয়ে রাধা কেঁদে বললে, গাঙ্গুলি মশাই, পায়ে স্থান দাও। তোমার উঠোন ঝাঁট দিয়ে খাব আমার সেও ভালো।। কি করি, স্বীকার করলুম।

বিজয় নির্বাক হইয়া বসিয়া রহিল।

বৃদ্ধ বলিতে লাগিলেন, বিবাহ এ-বাড়িতেই হবে। দেখতে একটু খারাপ দেখাবে, নইলে আমার বাড়িতেই হতে পারত। গগন চাটুয্যের কে এক পিসি আছে, সে-ই কন্যা সম্প্রদান করবে। এখন কেবল মশাই রাজী হলেই হয়।

বিজয় মুখ তুলিয়া বলিল, রাজী হয়ে আমাকে কি করতে হবে বলুন? তাড়া দেব না—এই ত? বেশ, তাই হবে। এখন আপনি আসুন, নমস্কার।

নমস্কার মশাই, নমস্কার। হবেই ত, হবেই ত। আপনার ঠাকুর হলেন লক্ষপতি! প্রাতঃস্মরণীয় লোক, নাম করলে সুপ্রভাত হয়।

তা হয়, আপনি এখন আসুন।

আসি মশাই আসি—নমস্কার। বলিয়া ত্রিলোচন প্রস্থান করিলেন।

লোকটি চলিয়া গেলে বিজয় চুপ করিয়া বসিয়া নিজেকে বুঝাইতেছিল যে, তাহার মাথাব্যথা করিবার কি আছে? বস্তুতঃ, এ-ছাড়া মেয়েটিরই বা উপায় কি? ব্যাপারটা অভাবিতপূর্বও নয়, সংসারে ঘটে না তাও নয়, তবে তাহার দুশ্চিন্তা কিসের? হঠাৎ বিনোদ ঘোষের কথা মনে পড়িল, সেদিন সে বলিতেছিল, অনুরাধা দাদার সঙ্গে এই বলিয়া ঝগড়া করিয়াছে যে কুলের গৌরব লইয়া সে কি করিবে, সহজে দুটা খাইতে পরিতে যদি পায় সেই যথেষ্ট।

প্রতিবাদে গগন রাগ করিয়া বলিয়াছিল, তুই কি বাপ-পিতাম’র নাম ডোবাতে চাস? অনুরাধা জবাব দিয়াছিল, তুমি তাঁদের বংশধর, নাম বজায় রাখতে পার রেখো, আমি পারব না।

এ কথার বেদনা বিজয় বুঝিল না, নিজেও সে যে কৌলীন্য-সম্মান এতটুকু বিশ্বাস করে তাও না, কিন্তু তবুও তাহার সহানুভূতি গিয়া পড়িল গগনের ‘পরে এবং অনুরাধার তীক্ষ্ণ প্রত্যুত্তর যতই সে মনে মনে তোলাপাড়া করিতে লাগিল ততই তাহাকে লজ্জাহীন, লোভী ও হীন বলিয়া মনে হইতে লাগিল।

এদিকে উঠানে ক্রমশঃ লোক জমিতেছে, এইবার তাহাদিগকে লইয়া কাজ শুরু করিতে হইবে, কিন্তু আজ তাহার কিছুই ভাল লাগিল না। দরোয়ানকে দিয়া তাহাদের বিদায় করিয়া দিল এবং একাকী বসিয়া থাকিতে না পারিয়া কি ভাবিয়া সে একেবারে বাটীর মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইল। রান্নাঘরের সম্মুখের খোলা বারান্দায় মাদুর পাতিয়া অনুরাধা শুইয়া, তাহার দুই পাশে দুই ছেলে কুমার ও সন্তোষ,—মহাভারতের গল্প চলিতেছে। রাত্রের রান্নাটা সে বেলাবেলি সারিয়া লইয়া নিত্যই এমনি ছেলেদের লইয়া সন্ধ্যার পরে গল্প করে, তারপর কুমারকে খাওয়াইয়া বাহিরে তাহার পিতার কাছে পাঠাইয়া দেয়। জ্যোৎস্না রাত্রি, ঘন-পল্লব আমগাছের পাতার ফাঁক দিয়া আসিয়া টুকরা চাঁদের আলো স্থানে স্থানে তাহাদের গায়ের ‘পরে, মুখের ‘পরে পড়িয়াছে।

গাছের ছায়ায় একটা লোককে এদিকে আসিতে দেখিয়া অনুরাধা চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে?

আমি বিজয়।

তিনজনেই শশব্যস্তে উঠিয়া বসিল। সন্তোষ ছোটবাবুকে অত্যন্ত ভয় করে, প্রথম দিনের স্মৃতি সে ভুলে নাই, উসখুস করিয়া উঠিয়া গেল, কুমারও বন্ধুর অনুসরণ করিল।

বিজয় বলিল, ত্রিলোচন গাঙ্গুলিকে আপনি চেনেন? আজ তিনি আমার কাছে এসেছিলেন।

অনুরাধা বিস্মিত হইল, আপনার কাছে? কিন্তু আপনি ত তাঁর খাতক ন’ন।

না। কিন্তু হলে হয়ত আপনার সুবিধে হতো, আমার একদিনের অত্যাচার আপনি আর একদিন শোধ দিতে পারতেন।

অনুরাধা চুপ করিয়া রহিল।

বিজয় বলিল, তিনি জানিয়ে গেলেন, আপনার সঙ্গে তাঁর বিবাহ স্থির হয়েছে। এ কি সত্য?

হাঁ।

আপনি নিজে উপযাচক হয়ে তাকে রাজি করিয়েছেন?

হাঁ তাই।

তাই যদি হয়ে থাকে এ অত্যন্ত লজ্জার কথা। শুধু আপনার নয়, আমারও।

আপনার লজ্জা কিসের?

সেই কথা জানাতেই আমি এসেছি। ত্রিলোচন বলে গেল শুধু আমার তাড়াতেই বিভ্রান্ত হয়ে নাকি আপনি এ প্রস্তাব করেছেন। বলেছেন আপনার দাঁড়াবার স্থান নেই এবং বহু সাধ্যসাধনায় তাকে সম্মত করিয়েছেন, নইলে এ বয়সে বিবাহের ইচ্ছে সে ত্যাগ করেছিল। শুধু আপনার কান্নাকাটিতে দয়া করে ত্রিলোচন রাজী হয়েছে।

হাঁ, এ-সবই সত্যি।

বিজয় কহিল, আমার তাড়া দেওয়া আমি প্রত্যাহার করচি এবং নিজের আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করচি।

অনুরাধা চুপ করিয়া রহিল।

বিজয় বলিল, এবার নিজের তরফ থেকে আপনি প্রস্তাব প্রত্যাহার করুন।

না, সে হয় না। আমি কথা দিয়েছি—সবাই শুনেছে—লোকে তাঁকে উপহাস করবে।

এতে করবে না? বরঞ্চ ঢের বেশি করবে। তার উপযুক্ত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বিবাদ বাধবে, তাদের সংসারে একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, আপনার নিজের অশান্তির সীমা থাকবে না, এ-সব কথা কি ভেবে দেখেন নি?

অনুরাধা মৃদুকণ্ঠে বলিল, দেখেচি। আমার বিশ্বাস এ-সব কিছুই হবে না।

শুনিয়া বিজয় অবাক হইয়া গেল, কহিল, সে বৃদ্ধ ক’টা দিন বাঁচবে আশা করেন?

অনুরাধা বলিল, স্বামীর পরমায়ু সংসারে সকল স্ত্রীই বেশি আশা করে। এমনও হতে পারে হাতের নোয়া নিয়ে আমি আগে চলে যাব।

বিজয় এ কথার উত্তর খুঁজিয়া পাইল না, স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। কিছুক্ষণ এমনি নীরবে কাটিলে অনুরাধা বিনীত স্বরে কহিল, আপনি আমাকে চলে যেতে হুকুম করেছেন সত্যি, কিন্তু কোনদিন তার উল্লেখ পর্যন্ত করেন নি। দয়ার যোগ্য নই, তবু যথেষ্ট দয়া করেছেন, মনে মনে আমি যে কত কৃতজ্ঞ তা জানাতে পারিনে।

বিজয়ের কাছে উত্তর না পাইয়া সে বলিতে লাগিল, ভগবান জানেন আপনার বিরুদ্ধে কারো কাছে আমি একটা কথাও বলিনি। বললে আমার অন্যায় হ’তো,আমার মিছে কথা হ’তো। গাঙ্গুলিমশাই যদি কিছু বলে থাকেন সে তাঁর নিজের কথা, আমার নয় তবু তাঁর হয়ে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করি।

বিজয় জিজ্ঞাসা করিল, আপনাদের কবে বিয়ে, তেরই জ্যৈষ্ঠ? তা হলে প্রায় মাস-খানেক বাকি রইল—না?

হাঁ তাই।

এর আর পরিবর্তন নেই বোধ করি?

বোধ হয় নেই। অন্ততঃ, সেই ভরসাই তিনি দিয়ে গেছেন।

বিজয় বহুক্ষণ নীরবে থাকিয়া কহিল, তা হলে আর কিছু আমার বলবার নেই, কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ জীবনটা একবার ভেবে দেখলেন না, আমার এই বড় পরিতাপ।

অনুরাধা বলিল, একবার নয়, একশো-বার ভেবে দেখেছি ছোটবাবু। এই আমার রাত্রি-দিনের চিন্তা। আপনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার সত্যিই ভাষা খুঁজে পাইনে, কিন্তু আপনি নিজে একবার আমার সব কথা ভেবে দেখুন দিকি। অর্থ নেই, রূপ নেই, গৃহ নেই, অভিভাবকহীন একাকী পল্লীগ্রামের অনাচার অত্যাচার থেকে কোথাও গিয়ে দাঁড়াবার স্থান নেই—বয়স হলো তেইশ-চব্বিশ—ইনি ছাড়া আমাকে কে বিয়ে করতে চাইবে বলুন ত? তখন অন্নের জন্যে কার কাছে গিয়ে হাত পেতে দাঁড়াব? শুনে আপনারই বা কি মনে হবে?

এ সবই সত্য, প্রতিবাদে কিছুই বলিবার নাই। মিনিট দুই-তিন নিরুত্তরে দাঁড়াইয়া বিজয় গভীর অনুতাপের সহিত বলিল, এ সময়ে আপনার কি আমি কোন উপকারই করতে পারিনে? পারলে খুশি হবো।

অনুরাধা কহিল, আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন যা কেউ করত না। আপনার আশ্রয়ে আমি নির্ভয়ে আছি,—ছেলে দুটি আমার চন্দ্র-সূয্যি—এই আমার ঢের। আপনার কাছে প্রার্থনা, শুধু মনে মনে আর আমাকে আমার দাদার দোষের ভাগী করে রাখবেন না, আমি জেনে কোন অপরাধ করিনি।

সে আমি জানতে পেরেছি, আপনাকে বলতে হবে না। এই বলিয়া বিজয় ধীরে ধীরে বাহিরে চলিয়া গেল।

পাঁচ

কলিকাতা হইতে কিছু তরি-তরকারি ও ফলমূল মিষ্টান্ন আসিয়াছিল; বিজয় চাকরকে দিয়া ঝুড়িটা আনিয়া রান্নাঘরের সুমুখে নামাইয়া রাখিয়া বলিল, ঘরে আছেন নিশ্চয়ই—

ভিতরে হইতে মৃদুকণ্ঠে সাড়া আসিল, আছি।

বিজয় বলিল, মুশকিল হয়েছে আপনাকে ডাকার। আমাদের সমাজে হলে মিস চ্যাটার্জি কিংবা মিস অনুরাধা বলে অনায়াসে ডাকা চলত, কিন্তু এখানে তা অচল। আপনার ছেলে দুটোর কেউ উপস্থিত থাকলে ‘তোদের মাসীকে ডেকে দে’ বলে কাজ চালাতুম, কিন্তু তারাও ফেরার। কি বলে ডাকি বলুন ত?

অনুরাধা দ্বারের কাছে আসিয়া বলিল, আপনি মনিব, আমাকে রাধা বলে ডাকবেন।

বিজয় বলিল, ডাকতে আপত্তি নেই, কিন্তু মনিবানা স্বত্বের জোরে নয়। দায় ছিল গগন চাটুয্যের, কিন্তু সে দিলে গা–ঢাকা; মনিব বলে আপনি কেন মানতে যাবেন? আপনার গরজ কিসের?

ভিতর হইতে শুধু শোনা গেল, ও–কথা বলবেন না, আপনি মনিব বৈ কি।

বিজয় বলিল, সে দাবী করিনে, কিন্তু বয়েসের দাবী করি। আমি অনেক বড়, নাম ধরে ডাকলে যেন রাগ করবেন না।

না।

বিজয় এটা দেখিয়াছে যে, ঘনিষ্ঠতা করার আগ্রহ তাহার দিক দিয়া যত প্রবলই হোক, ও–পক্ষ হইতে লেশমাত্র নাই। সে কিছুতে সুমুখে আসে না এবং সংক্ষেপে ও সম্ভ্রমের সঙ্গে বরাবরই আড়াল হইতে উত্তর দেয়।

বিজয় বলিল, বাড়ি থেকে কিছু তরি–তরকারি, কিছু ফলমূল, মিষ্টি এসে পৌঁছেচে। ঝুড়িটা তুলে রাখুন, ছেলেদের দেবেন।

থাক। দরকার–মত রেখে আপনার বাইরে পাঠিয়ে দেব।

না, সে করবেন না। আমার বামুনটা রাঁধতেও জানে না, দুপুর থেকে দেখচি চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে। কি জানি আপনাদের দেশের ম্যালেরিয়া তাকে ধরলে কিনা। তা হলে ভোগাবে।

কিন্তু ম্যালেরিয়া ত আমাদের দেশে নেই। বামুন না উঠলে এ–বেলা আপনার রাঁধবে কে?

বিজয় বলিল, এ–বেলার কথা ছেড়ে দিন, ভেবে দেখব কাল সকালে। আর কুকারটা ত সঙ্গে আছেই, শেষ পর্যন্ত চাকরকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে পারব।

কিন্তু তাতে কষ্ট হবে ত?

না। নিজের অভ্যাস আছে, শুধু কষ্ট হতে পারত ছেলের খাবার কষ্ট চোখে দেখলে। কিন্তু সে ভার ত আপনি নিয়েছেন। কি রাঁধচেন এ–বেলা? ঝুড়িটা খুলে দেখুন না যদি কাজে লাগে।

কাজে লাগবে বৈ কি। কিন্তু এ–বেলা আমার রান্না নেই।

নেই? কেন?

কুমারের একটু গা–গরম হয়েছে, রাঁধলে সে খাবার উপদ্রব করবে। ও–বেলার যা আছে তাতে সন্তোষের চলে যাবে।

গা–গরম হয়েছে তার? কোথায় আছে সে?

আছে আমার বিছানায় শুয়ে—সন্তোষের সঙ্গে গল্প করচে। আজ বলছিল বাইরে যাবে না, আমার কাছে শোবে।

বিজয় বলিল, তা শুক, কিন্তু বেশী আদর পেলে মাসীকে ছেড়ে ও–বাড়ি যেতে চাইবে না। তখন ওকে নিয়ে বিভ্রাট বাধবে।

না, বাধবে না। কুমার অবাধ্য ছেলে নয়।

বিজয় বলিল, কি হলে অবাধ্য হয় সে আপনি জানেন, কিন্তু শুনতে পাই আপনার ’পরে ও কম উৎপাত করে না।

অনুরাধা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ও উপদ্রব যদি করে আমার ওপরেই করে, আর কারো ওপরে না।

বিজয় বলিল, সে আমি জানি। কিন্তু মাসীই না হয় সহ্য করলে, কিন্তু জ্যাঠাইমা সইবে না। আর বিমাতা যদি আসেন, তিনি এতটুকু অত্যাচারও বরদাস্ত করবেন না। অভ্যাস বিগড়ালে ওর বিপদ ঘটবে যে।

ছেলের বিপদ ঘটবে এমন বিমাতা ঘরে আনবেন কেন? না–ই বা আনলেন।

বিজয় বলিল, আনতে হয় না, ছেলের কপাল ভাঙ্গলে বিমাতা আপনি এসে ঘরে ঢোকেন। তখন বিপদ ঠেকাতে মাসীর শরণাপন্ন হতে হয়, অবশ্য তিনি যদি রাজী হন।

অনুরাধা বলিল, যার মা নেই মাসি তাকে ফেলতে পারে না, যত দুঃখে হোক মানুষ করে তোলেই।

কথাটা শুনে রাখলুম, বলিয়া বিজয় চলিয়া যাইতেছিল, ফিরিয়া আসিয়া কহিল, যদি অবিনয় মাপ করেন একটা কথা জিজ্ঞেসা করি।

করুন।

কুমারের চিন্তা পরে করা যাবে, কারণ তার বাপ বেঁচে আছে। তাকে যত পাষণ্ড লোকে ভাবে সে তা নয়। কিন্তু সন্তোষ? তার ত বাপ–মা দুই–ই গেছে, নতুন মেসো ত্রিলোচনের ঘরে যদি তার ঠাঁই না হয়, কি করবেন তাকে নিয়ে? ভেবেচেন সে কথা?

অনুরাধা বলিল, মাসীর ঠাঁই হবে, বোনপোর হবে না?

হওয়াই উচিত, কিন্তু যেটুকু তাঁর দেখতে পেলুম তাতে ভরসা বড় হয় না।

এ কথার জবাব অনুরাধা তৎক্ষণাৎ দিতে পারিল না, ভাবিতে একটু সময় লাগিল, তারপরে শান্ত দৃঢ়কণ্ঠে কহিল, তখন গাছতলায় দু’জনের স্থান হবে। সে কেউ বন্ধ করতে পারবে না।

বিজয় বলিল, মাসীর যোগ্য কথা অস্বীকার করিনে, কিন্তু সে সম্ভব নয়। তখন আমার কাছে তাকে পাঠিয়ে দেবেন। কুমারের বন্ধু ও, সে যদি মানুষ হয় সন্তোষও হবে।

ভিতর হইতে আর কোন জবাব আসিল না, বিজয় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া বাহিরে চলিয়া গেল।

ঘণ্টা দুই–তিন পরে দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া সন্তোষ বলিল, মাসীমা আপনাকে খেতে ডাকচেন।

আমাকে?

হাঁ, বলিয়াই সে প্রস্থান করিল।

অনুরাধার রান্নাঘরে খাবার ঠাঁই করা। বিজয় আসনে বসিয়া বলিল, রাত্রিটা অনায়াসে কেটে যেত, কেন আবার কষ্ট করলেন?

অনুরাধা অনতিদূরে দাঁড়াইয়া ছিল, চুপ করিয়া রহিল।

ভোজ্যবস্তুর বাহুল্য নাই, কিন্তু যত্নের পরিচয় প্রত্যেকটি জিনিসে। কি পরিপাটি করিয়াই না খাবারগুলি সাজানো। আহারে বসিয়া বিজয় জিজ্ঞাসা করিল, কুমার কি খেলে?

সাগু খেয়ে সে ঘুমিয়েছে।

ঝগড়া করেনি আজ?

অনুরাধা হাসিয়া ফেলিল, বলিল, আমার কাছে শোবে বলে আজ ও ভারী শান্ত। মোটে ঝগড়া করেনি।

বিজয় বলিল, ওকে নিয়ে আপনার ঝঞ্ঝাট বেড়েচে কিন্তু আমার দোষে নয়। ও নিজেই কি করে যে আপনার সংসারের মধ্যে নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল তাই আমি ভাবি।

আমিও ঠিক তাই ভাবি।

মনে হয়, ও বাড়ি চলে গেলে আপনার কষ্ট হবে।

অনুরাধা চুপ করিয়া রহিল, পরে বলিল, নিয়ে যাবার আগে কিন্তু আপনাকে একটি কথা দিয়ে যেতে হবে। আপনাকে চোখ রাখতে হবে ও যেন কষ্ট না পায়।

কিন্তু আমি ত থাকি বাইরে নানা কাজে ব্যস্ত, কথা রাখতে পারব বলে ভরসা হয় না।

তা হলে আমার কাছে ওকে দিয়ে যেতে হবে।

আপনি ভুলে যাচ্চেন যে সে আরও অসম্ভব। এই বলিয়া বিজয় হাসিয়া খাওয়ায় মন দিল। একসময়ে বলিল, আমার বৌদিদিদের আসার কথা ছিল, কিন্তু তাঁরা বোধ করি আর এলেন না।

কেন?

যে খেয়ালে বলেছিলেন সম্ভবত: সেটা কেটে গেছে। শহরের লোক পাড়াগাঁয়ে সহজে পা বাড়াতে চান না। একপ্রকার ভালই হয়েছে। একা আমিই ত আপনার যথেষ্ট অসুবিধে ঘটিয়েছি, তাঁরা এলে সেটা বাড়ত।

অনুরাধা এ কথার প্রতিবাদ করিয়া বলিল, এ বলা আপনার অন্যায়। বাড়ি আমার নয়, আপনাদের। তবু আমিই সমস্ত জায়গা জুড়ে বসে থাকব, তাঁরা এলে রাগ করব, এর চেয়ে অন্যায় হতেই পারে না। আমার সম্বন্ধে এমন কথা ভাবা আমার প্রতি সত্যিই আপনার অবিচার। যত দয়া আমাকে করেছেন আমার দিক থেকে এই কি তার প্রতিদান?

এত কথা এমন করিয়া সে কখনো বলে নাই। জবাব শুনিয়া বিজয় আশ্চর্য হইয়া গেল,—যতটা অশিক্ষিত এই পাড়াগাঁয়ের মেয়েটিকে সে ভাবিয়াছিল তাহা নয়। একটুখানি স্থির থাকিয়া আপন অপরাধ স্বীকার করিয়া কহিল, সত্যই এ কথা বলা আমার উচিত হয়নি। যাদের সম্বন্ধে এ কথা খাটে আপনি তাদের চেয়ে অনেক বড়। কিন্তু দু–তিনদিন পরেই আমি বাড়ি চলে যাব, এখানে এসে প্রথমে আপনার প্রতি নানা দুর্ব্যবহার করেচি, কিন্তু সে না-জানার জন্যে। অথচ, সংসারে এমনিই হয়, এমনিই ঘটে। তবু, যাবার আগে আমি গভীর লজ্জার সঙ্গে আপনার ক্ষমা ভিক্ষা করি।

অনুরাধা মৃদুকণ্ঠে বলিল, ক্ষমা আপনি পাবেন না।

পাব না? কেন?

এসে পর্যন্ত যে অত্যাচার করেছেন তার ক্ষমা নেই, এই বলিয়া সে হাসিয়া ফেলিল।

প্রদীপের স্বল্প আলোকে তাহার হাসিমুখ বিজয়ের চোখে পড়িল এবং মুহূর্তকালের এক অজানা বিস্ময়ে সমস্ত অন্তরটা দুলিয়া উঠিয়াই আবার স্থির হইল। ক্ষণকাল নির্বাক থাকিয়া বলিল, সেই ভালো, ক্ষমায় কাজ নেই। অপরাধী বলেই যেন চিরকাল মনে পড়ে।

উভয়েই নীরব। মিনিট দুই–তিন ঘরটা সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিল।

নিঃশব্দতা ভঙ্গ করিল অনুরাধা। জিজ্ঞাসা করিল, আপনি আবার কবে আসবেন?

মাঝে মাঝে আসতেই হবে জানি, যদিচ দেখা আর হবে না।

ও পক্ষ হইতে ইহার প্রতিবাদ আসিল না, বুঝা গেল ইহা সত্য।

খাওয়া শেষ হইলে বিজয় বাহিরে যাইবার সময়ে অনুরাধা বলিল, ঝুড়িটায় অনেক রকম তরকারি আছে, কিন্তু বাইরে আর পাঠালুম না। কাল সকালেও আপনি এখানেই খাবেন।

তথাস্তু। কিন্তু বুঝেছেন বোধ করি সাধারণের চেয়ে ক্ষিদেটা আমার বেশি। নইলে প্রস্তাব করতুম শুধু সকালে নয়, নেমন্তন্নর মেয়াদটা বাড়িয়ে দিন যে–কটা দিন থাকি, আপনার হাতে খেয়েই যেন বাড়ি চলে যেতে পারি।

উত্তর আসিল, সে আমার সৌভাগ্য।

পরদিন প্রভাতেই বহুবিধ আহার্য–দ্রব্য অনুরাধার রান্নাঘরের বারান্দায় আসিয়া পৌঁছিল। সে আপত্তি করিল না, তুলিয়া রাখিল।

ইহার পরে তিন দিনের স্থলে পাঁচ দিন কাটিল। কুমার সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া উঠিল। এই কয়দিন বিজয় ক্ষোভের সহিত লক্ষ্য করিল যে, আতিথ্যের ত্রুটি কোনদিকে নাই, কিন্তু পরিচয়ের দূরত্ব তেমনি অবিচলিত রহিল, কোন ছলেই তিলার্ধ সন্নিকটবর্তী হইল না। বারান্দায় খাবার জায়গা করিয়া দিয়া অনুরাধা ঘরের মধ্যে হইতে সাজাইয়া গুছাইয়া দেয়, পরিবেশন করে সন্তোষ। কুমার আসিয়া বলে, বাবা, মাসীমা বললেন মাছের তরকারিটা অতখানি পড়ে থাকলে চলবে না, আর একটু খেতে হবে। বিজয় বলে, তোমার মাসীমাকে বল গে বাবাকে রাক্ষস ভাবা তাঁর অন্যায়। কুমার ফিরিয়া আসিয়া বলে, মাছের তরকারি থাক, ও বোধ হয় ভালো হয়নি, কিন্তু কালকের মত বাটিতে দুধ পড়ে থাকলে তিনি দুঃখ করবেন। বিজয় শুনাইয়া বলিল, তোমার মাসী যেন কাল থেকে গামলার বদলে বাটিতে করেই দুধ দেন, তা হলে পড়ে থাকবে না।

ছয়

এমনি করিয়া এই পাঁচটা দিন কাটিল। মেয়েদের যত্নের ছবিটা বিজয়ের মনে ছিল চিরদিনই অস্পষ্ট, মাকে সে ছেলেবেলা হইতে অসুস্থ ও অপটু দেখিয়াছে, গৃহিণীপনার কোন কর্তব্যই তিনি সম্পূর্ণ করিয়া উঠিতে পারেন নাই—নিজের স্ত্রীও ছিল মাত্র বছর–দুই জীবিত—তখন তাহার পাঠ্যাবস্থা। ইহার পরে হইতে দীর্ঘকাল কাটিয়া গেল সুদূর প্রবাসে। সেদিকের অভিজ্ঞতার ভালো–মন্দ অনেক স্মৃতি মাঝে মাঝে মনে পড়ে, কিন্তু সমস্তই যেন অবাস্তব বইয়ে পড়া কল্পিত কাহিনী। জীবনের সত্য প্রয়োজনে একেবারে সম্বন্ধবিহীন।

আর আছে তাহার দাদার স্ত্রী প্রভাময়ী। যে পরিবারে বৌদিদিদের বিচার চলে, ভালো–মন্দর আলোচনা হয়, সে পরিবার তাহাদের নয়। মাকে অনেকদিন কাঁদিতে দেখিয়াছে, বাবা বিরক্ত ও বিমর্ষ হইয়াছেন, কিন্তু এ–সকল সে নিজেই অসঙ্গত ও অনধিকার–চর্চা মনে করিয়াছে। জ্যাঠাইমা দেবর–পুত্রের খোঁজ না রাখিলে, বধূ শ্বশুর–শাশুড়ীর সেবা না করিলে যে প্রচণ্ড অপরাধ হয়, এ ধারণা তাহার নয়। তাহার নিজের স্ত্রীকেও অনুরূপ আচরণ করিতে দেখিলে সে যে মর্মাহত হইত তাহাও নয়। কিন্তু তাহার এতকালের ধারণাকে এই শেষের পাঁচটা দিন যেন ধাক্কা দিয়া নড়বড়ে করিয়া দিল। আজ সন্ধ্যার ট্রেনে তাহার যাত্রা করিবার সময়, চাকর জিনিসপত্র বাঁধিয়া প্রস্তুত করিতেছে, আর ঘণ্টা–কয়েক মাত্র দেরি, সন্তোষ আসিয়া আড়াল হইতে বলিল, মাসীমা খেতে ডাকচেন।

এমন সময়ে?

হাঁ, বলিয়াই সে সরিয়া পড়িল।

বিজয় ভিতরে আসিয়া দেখিল যথারীতি বারান্দায় আসন পাতিয়া ঠাঁই করা হইয়াছে; মাসির গলা ধরিয়া কুমার ঝুলিতেছিল, তাহার হাত হইতে নিজেকে মুক্ত করিয়া অনুরাধা রান্নাঘরে গিয়া প্রবেশ করিল।

আসনে বসিয়া বিজয় কহিল, এ কি ব্যাপার!

ভিতর হইতে অনুরাধা বলিল, দুটি খিচুড়ি রেঁধে রেখেচি, খেতে বসুন।

জবাব দিতে গিয়া আজ বিজয়কে গলাটা একটু পরিষ্কার করিয়া লইতে হইল, কহিল, অসময়ে কেন আবার কষ্ট করতে গেলেন? আর যদি করলেন খান–কতক লুচি ভেজে দিলেই হ’তো।

অনুরাধা কহিল, লুচি ত আপনি খান না। বাড়ি পৌঁছতে রাত্রি দুটো–তিনটে বাজবে, না খেয়ে উপোস করে গেলেই কি কষ্ট আমার কম হবে? কেবলি মনে পড়বে ছেলেটা না খেয়ে গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছে।

বিজয় নীরবে কিছুক্ষণ আহার করিয়া বলিল, বিনোদকে বলে গেলুম সে যেন আপনাকে দেখে। যে–ক’টা দিন এ–বাড়িতে আছেন যেন অসুবিধে কিছু না হয়।

সে আবার কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া বলিল, আর একটা কথা জানিয়ে যাই। যদি দেখা হয় গগনকে বলবেন, আমি তাকে মাপ করেচি, কিন্তু এ গাঁয়ে যেন আর না সে আসে। এলে ক্ষমা করব না।

কখনো দেখা হলে তাঁকে জানাব, এই বলিয়া অনুরাধা ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, মুশকিল হয়েছে কুমারকে নিয়ে। আজ সে কিছুতেই যেতে চাচ্চে না। অথচ কেন যে চাচ্চে না তাও বলে না।

বিজয় কহিল, বলতে চায় না নিজেই জানে না বলে। অথচ, মনে মনে বোঝে সেখানে গেলে ওর কষ্ট হবে।

কষ্ট হবে কেন?

সে বাড়ির নিয়ম ওই। কিন্তু হ’লোই বা কষ্ট, এর মধ্যে দিয়েই ত ও এত বড় হ’লো।

তা হলে গিয়ে কাজ নেই। থাক আমার কাছে।

বিজয় সহাস্যে কহিল, আমার আপত্তি নেই, কিন্তু বড়জোর এই মাসটা, তার বেশী ত থাকতে পারবে না–তাতে লাভ কি?

উভয়েই মৌন হইয়া রহিল।

অনুরাধা বলিল, ওর বিমাতা যিনি আসবেন শুনেচি তিনি শিক্ষিতা মেয়ে।

হ্যাঁ, তিনি বি. এ. পাস করেছেন।

কিন্তু, বি. এ. পাস ত ওর জ্যাঠাইমাও করেছেন।

নিশ্চয় করেছেন। কিন্তু বি. এ. পাসের কেতাবের মধ্যে দেওরপোকে যত্ন করার কথা লেখা নেই। সে পরীক্ষা তাঁকে দিতে হয়নি।

কিন্তু রুগ্ন শ্বশুর–শাশুড়ী? সে কথাও কি কেতাবে লেখে না?

না। এ প্রস্তাব আরও হাস্যকর।

হাস্যকর নয় এমন কি কিছু আছে?

আছে। বিন্দুমাত্র অনুযোগ না করাই হচ্ছে আমাদের সমাজের সুভদ্র বিধি।

অনুরাধা ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, এ বিধি আপনাদেরই থাক। কিন্তু যে বিধি সকলের সমান সে হচ্চে এই যে, ছেলের চেয়ে বি. এ. পাস বড় নয়। এমন মেয়েকে ঘরে আনা অনুচিত।

কিন্তু আনতে কাউকে ত হবেই। যে দলের আবহাওয়ার মধ্যে গিয়ে আমরা দাঁড়িয়েছি সেখানে বি. এ. পাস নইলে মানও বাঁচে না, মনও বোঝে না। এবং বোধ হয় ঘরও চলে না। মা-বাপ-মরা বোনপোর জন্যে গাছতলা স্বীকার করে নিতে চায় এমন মেয়ে নিয়ে আমাদের বনবাস করা চলে, কিন্তু সমাজে বাস করা চলে না।

অনুরাধার কণ্ঠস্বর পলকের জন্য তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল—না, সে হবে না। একজন নির্দয় বিমাতার হাতে তুলে দিতে ওকে আপনি পারবেন না।

বিজয় কহিল, সে ভয় নেই। কারণ, তুলে দিলেও হাত থেকে আপনিই গড়িয়ে কুমার নীচে এসে পড়বে। কিন্তু তাই বলে তিনি নির্দয়ও নয়, এবং আমার ভাবী পত্নীর স্বপক্ষে আপনার কথার আমি তীব্র প্রতিবাদ করি। মার্জিত রুচিসম্মত উদাস অবহেলায় তাঁদের নেতিয়ে–পড়া আত্মীয়তায় বর্বরতার লেশ নেই। ও দোষটা দেবেন না।

অনুরাধা হাসিয়া বলিল, প্রতিবাদ যত খুশি করুন, কিন্তু জিজ্ঞেসা করি, নেতিয়ে-পড়া আত্মীয়তার মানেটা হলো কি?

বিজয় বলিল, ও আমাদের বড় সার্কেলের পারিবারিক বন্ধন। ওর কোড আলাদা, চেহারা স্বতন্ত্র। ওর শেকড় টানে না রস, পাতার রঙ সবুজ না হতেই ধরে হলুদের বর্ণ। আপনি পাড়াগাঁয়ে গৃহস্থঘরের মেয়ে, ইস্কুলে-কলেজে পড়ে পাস করেন নি, পার্টিতে পিকনিকে মেশেন নি, ওর নিগূঢ় অর্থ আপনাকে আমি বোঝাতে পারব না, কেবল এইটুকু আশ্বাস দিতে পারি কুমারের বিমাতা এসে তাকে বিষ খাওয়াবার আয়োজনও করবেন না, চাবুক-হাতে তাড়া করেও বেড়াবেন না। কারণ সে মার্জিত রুচিবিরুদ্ধ আচরণ। সুতরাং সেদিকে নির্ভয় হতে পারেন।

অনুরাধা বলিল, আমি তাঁর কথা ছেড়ে দিলুম, কিন্তু আপনি নিজে দেখবেন কথা দিন। এই আমার মিনতি।

বিজয় কহিল, কথা দিতেই ইচ্ছে করে, কিন্তু, আমার স্বভাবও আলাদা, অভ্যাসও আলাদা। আপনার আগ্রহ স্মরণ করে মাঝে মাঝে দেখবার চেষ্টা করব, কিন্তু যতটা আপনি চান তা পেরে উঠব মনে হয় না। কিন্তু আমার খাওয়া শেষ হলো এখন যাই। যাবার উদ্যোগ করি গে। বলিয়া সে উঠিয়া পড়িল, কহিল, রইল কুমার আপনার কাছে, ওকে ছাড়বার দিন এলে দেবেন বিনোদকে দিয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে। প্রয়োজন হয় অসঙ্কোচে সন্তোষকেও সঙ্গে দেবেন। প্রথমে এসে যে ব্যবহার করেচি ঠিক সেই আমার প্রকৃতি নয়। এ ভরসা আর একবার দিয়ে চললুম—আমার বাড়িতে কুমারের চেয়ে বেশি অনাদর সন্তোষের ঘটবে না।

বাড়ির সম্মুখে ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়াইয়া, জিনিসপত্র বোঝাই দেওয়া হইয়াছে; বিজয় উঠিতে যাইতেছে, কুমার বলিল, বাবা, মাসীমা ডাকচেন একবার।

সদর দরজার পাশে দাঁড়াইয়া অনুরাধা কহিল, প্রণাম করব বলে ডেকে পাঠালুম, আবার কবে যে করতে পাবো জানিনে। এই বলিয়া গলায় আঁচল দিয়া দূর হইতে প্রণাম করিল। উঠিয়া দাঁড়াইয়া কুমারকে কোলের কাছে টানিয়া লইয়া বলিল, ঠাকুরমাকে ভাবতে বারণ করবেন। যে–ক’টা দিন ছেলেটা আমার কাছে রইল অযত্ন হবে না।

বিজয় হাসিয়া বলিল, বিশ্বাস করা কঠিন।

কঠিন কার কাছে? আপনার কাছেও নাকি? বলিয়া সেও হাসিতে গিয়া দু’জনের চোখাচোখি হইল। বিজয় স্পষ্ট দেখিতে পাইল তাহার চোখের পাতা দুটি জলে ভিজা। মুখ নামাইয়া বলিল, কুমারকে নিয়ে গিয়ে কিন্তু কষ্ট দেবেন না যেন। আর বলতে পাব না বলেই বার বার করে বলে রাখচি। আপনাদের বাড়ির কথা মনে হলে ওকে পাঠাতে আমার ইচ্ছে হয় না।

না-ই বা পাঠালেন।

প্রত্যুত্তরে সে শুধু একটা নিঃশ্বাস চাপিয়া চুপ করিয়া রহিল।

বিজয় বলিল, যাবার পূর্বে আপনার প্রতিশ্রুতির কথাটা আর একবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাই। কথা দিয়েছেন কখনো কিছু প্রয়োজন হলে চিঠি লিখে আমাকে জানাবেন।

আমার মনে আছে। জানি, গাঙ্গুলিমশায়ের কাছে ভিক্ষুকের মতই আমাকে চাইতে হবে, মনের সমস্ত ধিক্কার বিসর্জন দিয়েই চাইতে হবে, কিন্তু আপনার কাছে তা নয়। যা চাইব স্বচ্ছন্দে চাইব।

কিন্তু মনে থাকে যেন, এই বলিয়া বিজয় যাইতে উদ্যত হইলে সে কহিল, তবে আপনিও একটা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। বলুন প্রয়োজন হলে আমাকেও জানাবেন?

জানাবার মত আমার কি প্রয়োজন হবে অনুরাধা?

তা কি করে জানব। আমার আর কিছু নেই, কিন্তু প্রয়োজন হলে প্রাণ দিয়ে সেবা করতেও ত পারব।

আপনাকে ওরা করতে দেবে কেন?

আমাকে কেউ বাধা দিতে পারবে না।

সাত

কুমার আসে নাই শুনিয়া মা আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিলেন—সে কি কথা রে! যার সঙ্গে ঝগড়া তার কাছেই ছেলে রেখে এলি?

বিজয় বলিল, যার সঙ্গে ঝগড়া সে গিয়ে পাতালে ঢুকেচে মা, তাকে খুঁজে বার করে সাধ্য কার? তোমার নাতি রইল তার মাসীর কাছে। দিন-কয়েক পরেই আসবে।

হঠাৎ মাসী এল কোথা থেকে রে?

বিজয় বলিল, ভগবানের তৈরি সংসারে হঠাৎ কে যে কোথা থেকে এসে পৌঁছায়, মা, কেউ বলতে পারে না। যে তোমার টাকাকড়ি নিয়ে ডুব মেরেছে এ সেই গগন চাটুয্যের ছোটবোন। বাড়ি থেকে একেই তাড়াব বলে লাঠিসোঁটা পিয়াদা-পাইক নিয়ে রণসজ্জায় যাত্রা করেছিলুম, কিন্তু তোমার আপনার নাতিই করলে গোল। এমনি তার আঁচল চেপে রইল যে দু’জনকে একসঙ্গে না তাড়ালে আর তাড়ানো চলল না।

মা ব্যাপারটা আন্দাজ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কুমার বুঝি তার খুব অনুগত হয়ে পড়েচে? মেয়েটা খুব যত্নআত্তি করে বুঝি? বাছা যত্ন ত কখনো পায় না। এই বলিয়া তিনি নিজের অস্বাস্থ্য স্মরণ করিয়া নিঃশ্বাস ফেলিলেন।

বিজয় বলিল, আমি ছিলুম বাইরে, বাড়ির ভেতরে কে কাকে কি যত্ন করত চোখে দেখিনি, কিন্তু আসবার সময়ে কুমার মাসীকে ছেড়ে কিছুতে আসতে চাইলে না।

মার তথাপি সন্দেহ ঘুচিল না, বলিলেন, ওরা পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, কত রকম জানে। সঙ্গে না এনে ভালো করিস নি বাবা।

বিজয় বলিল, তুমি নিজে পাড়াগাঁয়ের মেয়ে হয়ে পাড়াগাঁয়ের বিরুদ্ধে তোমার এই নালিশ! শেষকালে তোমার বিশ্বাস গিয়ে পড়ল বুঝি শহরের মেয়ের ওপর?

শহরের মেয়ে! তাঁদের চরণে কোটি কোটি নমস্কার!—এই বলিয়া মা দুই হাত এক করিয়া কপালে ঠেকাইলেন।

বিজয় হাসিয়া ফেলিল।

মা বলিলেন, হাসচিস কি রে! আমার দুঃখ কেবল আমিই জানি, আর জানেন তিনি। বলিতে বলিতে তাঁহার চোখ ছলছল করিয়া আসিল, কহিলেন, আমরা যখনকার, সে পাড়াগাঁ কি আর আছে বাবা? দিন-কাল সব বদলে গেছে।

বিজয় বলিল, অনেক বদলেছে, কিন্তু যতদিন তোমরা বেঁচে আছ বোধ হয় তোমাদের পুণ্যেই এখনো কিছু বাকি আছে মা, একেবারে লোপ পায়নি। তারই একটুখানি এবারে দেখে এলুম। কিন্তু তোমাকে যে সে জিনিস দেখাবার জো নেই এই দুঃখটাই মনে রইল। এই বলিয়া সে অফিসে বাহির হইয়া গেল। অফিসের কাজের তাড়াতেই ব্যস্ত হইয়া তাহাকে চলিয়া আসিতে হইয়াছে।

বিকালে অফিস হইতে ফিরিয়া বিজয় ও মহলে বৌদিদির সঙ্গে দেখা করিতে গেল। গিয়া দেখিল সেখানে বাধিয়াছে কুরুক্ষেত্র কাণ্ড। প্রসাধনের জিনিসপত্র ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত, দাদা ইজিচেয়ারের হাতলে বসিয়া প্রবল-কণ্ঠে বলিতেছেন, কখ্‌খনো না। যেতে হয় একলা যাও। এমন কুটুম্বিতেয় আমি দাঁড়িয়ে—ইত্যাদি।

অকস্মাৎ বিজয়কে দেখিয়া প্রভা হাউমাউ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল,—ঠাকুরপো, তারা যদি সিতাংশুর সঙ্গে অনিতার বিয়ে ঠিক করে থাকে সে কি আমার দোষ? আজ পাকাদেখা, উনি বলচেন যাবেন না। তার মানে আমাকেও যেতে দেবেন না।

দাদা গর্জিয়া উঠিলেন—তুমি জানতে না বলতে চাও? আমাদের সঙ্গে এ জুচ্চুরি চালাবার এতদিন কি দরকার ছিল?

কথাটা সহসা ধরিতে না পারিয়া বিজয় হতবুদ্ধি হইল, কিন্তু বুঝিতেও বিলম্ব হইল না, কহিল, রসো রসো। হয়েচে কি বল ত? অনিতার সঙ্গে সিতাংশু ঘোষালের বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয়েছে? আজই তার পাকাদেখা? I am thrown completely overboard!

দাদা হুঙ্কার দিলেন—হুঁ। আর উনি বলতে চান কিছুই জানতেন না!

প্রভা কাঁদিয়া বলিল, আমি কি করতে পারি ঠাকুরপো। দাদা রয়েচেন, মা রয়েচেন, মেয়ে নিজে বড় হয়েচে, তারা যদি কথা ভাঙ্গে আমার দোষ কি?

দাদা বলিলেন, দোষ এই যে তারা ধাপ্পাবাজ ভণ্ড মিথ্যেবাদী। একদিকে কথা দিয়ে আর একদিকে গোপনে টোপ ফেলে বসেছিল। এখন লোকে মুখ টিপে হাসবে,—আমি ক্লাবে পার্টিতে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।

প্রভা তেমনি কান্নার সুরে বলিতে লাগিল, এমনধারা কি আর হয় না? তাতে তোমার লজ্জা কিসের?

আমার লজ্জা সে তোমার বোন বলে। আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই জোচ্চোর বলে। তাতে তোমারও একটা বড় অংশ আছে বলে।

দাদার মুখের প্রতি চাহিয়া এবার বিজয় হাসিয়া ফেলিল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ হেঁট হইয়া প্রভার পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া প্রসন্নমুখে কহিল, বৌদি, দাদা যত গর্জনই করুন, আমি রাগ বা দুঃখ ত করবই না, বরঞ্চ সত্যিই যদি এতে তোমার অংশ থাকে, তোমার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। মুখ ফিরাইয়া বলিল, দাদা, রাগ করা তোমার সত্যিই বড় অন্যায়। এ ব্যাপারে কথা দেওয়ার কোন অর্থ নেই যদি পরিবর্তনের সুযোগ থাকে। বিয়েটা ত ছেলেখেলা নয়। সিতাংশু আই. সি. এস. হয়ে ফিরেচে। সে একটা বড় দরের লোক। অনিতা দেখতে ভালো, বি. এ. পাস করেছে—আর আমি? এখানেও পাস করিনি, বিলেতেও সাত–আট বচ্ছর কাটিয়ে একটা ডিগ্রি যোগাড় করতে পারিনি, —সম্প্রতি কাঠের দোকানে কাঠ বিক্রি করে খাই, না আছে পদ-গৌরব, না আছে খেতাব। অনিতা কোন অন্যায় করেনি দাদা।

দাদা সরোষে কহিলেন, একশো বার অন্যায় করেছে। তুই বলতে চাস এতে তোর কোন কষ্টই হয়নি?

বিজয় কহিল, দাদা, তুমি গুরুজন—মিথ্যে বলব না—এই তোমার পা ছুঁয়ে বলচি, আমার এতটুকু দুঃখ নেই। নিজের পুণ্যে ত নয়, কার পুণ্যে ঘটল জানিনে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন আমি বেঁচে গেলুম। বৌদি, চল আমি তোমাকে নিয়ে যাই। দাদার ইচ্ছে হয় রাগ করে ঘরে বসে থাকুন, কিন্তু আমরা চল তোমার বোনের পাকাদেখায় পেট-পুরে খেয়ে আসি গে।

প্রভা তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া বলিল, তুমি কি আমাকে ঠাট্টা করচো ঠাকুরপো?

না বৌদি, ঠাট্টা করিনি। আজ একান্ত-মনে তোমার আশীর্বাদ প্রার্থনা করি, তোমার বরে ভাগ্য যেন এবার আমাকে মুখ তুলে চায়। কিন্তু আর দেরি ক’রো না, তুমি কাপড় পরে নাও, আমিও অফিসের পোশাকটা ছেড়ে আসি গে।—বলিয়া সে দ্রুত চলিয়া যাইতেছিল, দাদা বলিলেন, তোর নেমন্তন্ন নেই, তুই সেখানে যাবি কি করে?

বিজয় থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, তা বটে। তারা হয়ত লজ্জা পাবে। কিন্তু বিনা আহ্বানে কোথাও যেতেই আজ আমার সঙ্কোচ নেই, ছুটে গিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, অনিতা, তুমি আমাকে ঠকাও নি, তোমার উপর আমার রাগ নেই, জ্বালা নেই,—প্রার্থনা করি তুমি সুখী হও। দাদা, আমার মিনতি রাখো, রাগ করে থেকো না, বৌদিদিকে নিয়ে যাও, অন্ততঃ আমার হয়েও অনিতাকে আশীর্বাদ করে এসো তোমরা।

দাদা ও বৌদি উভয়েই হতবুদ্ধির মত তাহার প্রতি চাহিয়া রহিল। সহসা উভয়েরই চোখে পড়িল বিজয়ের মুখের ’পরে বিদ্রূপের সত্যই কোন চিহ্ন নাই, ক্রোধের অভিমানের লেশমাত্র ছায়া কণ্ঠস্বরে পড়ে নাই—সত্যই যেন কোন সুনিশ্চিত বিপদের ফাঁস এড়াইয়া মন তাহার অকৃত্রিম পুলকে ভরিয়া গেছে। বোনের কাছে এ ইঙ্গিত উপভোগ্য নয়, অপমানের ধাক্কায় প্রভার অন্তরটা সহসা জ্বলিয়া গেল, কি যেন একটা বলিতেও চাহিল, কিন্তু কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া রহিল।

বিজয় বলিল, বৌদি, আমার সকল কথা বলবার আজও সময় আসেনি, কখনো আসবে কিনা তাও জানিনে, যদি আসে কোনদিন, সেদিন কিন্তু তুমিও বলবে, ঠাকুরপো, তুমি ভাগ্যবান ভাই। তোমাকে আশীর্বাদ করি।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

উপন্যাস

পল্লী সমাজ
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

Avatar

Published

on

By

বেণী ঘোষাল মুখুয্যেদের অন্দরের প্রাঙ্গণে পা দিয়াই সম্মুখে এক প্রৌঢ়া রমণীকে পাইয়া প্রশ্ন করিলেন, “এই যে মাসি, রমা কই গা?” মাসী আহ্নিক করিতেছিলেন, ইঙ্গিতে রান্নাঘর দেখাইয়া দিলেন। বেণী উঠিয়া আসিয়া রন্ধনশালার চৌকাঠের বাহিরে দাঁড়াইয়া বলিলেন, “তা হ’লে রমা, কি কর্‌বে স্থির করলে?” জ্বলন্ত উনান হইতে শব্দায়মান কড়াটা নামাইয়া রাখিয়া রমা মুখ তুলিয়া চাহিল,—“কিসের বড়দা?”

বেণী কহিলেন, “তারিণী খুড়োর শ্রাদ্ধের কথাটা বোন্‌! রমেশ ত কা’ল এসে হাজির হয়েছে। বাপের শ্রাদ্ধ খুব ঘটা ক’রেই কর্‌বে ব’লে বোধ হচ্চে;—যাবে নাকি?”

রমা দুই চক্ষু বিস্ময়ে বিস্ফারিত করিয়া বলিল, “আমি যাব তারিণী ঘোষালের বাড়ী?” বেণী ঈষৎ লজ্জিত হইয়া কহিল—“সে ত জানি দিদি! আর যেই যাক্, তোরা কিছুতেই সেখানে যাবিনে। তবে শুন্‌চি নাকি, ছোঁড়া সমস্ত বাড়ী-বাড়ী নিজে গিয়ে বল্‌বে—বজ্জাতি বুদ্ধিতে সে তার বাপেরও ওপরে যায়—যদি আসে, তা হ’লে কি বল্‌বে?” রমা সরোষে জবাব দিল,—“আমি কিছুই বোল্‌বো না—বাইরের দরওয়ান তার উত্তর দেবে—” পূজানিরতা মাসীর কর্ণরন্ধ্রে এই অত্যন্ত রুচিকর দলাদলির আলোচনা পৌঁছিবামাত্রই তিনি আহ্নিক ফেলিয়া রাখিয়া উঠিয়া আসিলেন। বোন্‌ঝির কথা শেষ না হইতেই অত্যুত্তপ্ত খৈএর মত ছিট্‌কাইয়া উঠিয়া কহিলেন, “দরওয়ান কেন? আমি বল্‌তে জানিনে? নচ্ছার ব্যাটাকে এম্‌নি বলাই বল্‌ব যে, বাছাধন জন্মে কখন আর মুখুয্যেবাড়ীতে মাথা গলাবে না। তারিণী ঘোষালের ব্যাটা ঢুকবে নেমত্যন্ন কর্‌তে আমার বাড়ীতে? আমি কিছুই ভুলিনি বেণীমাধব! তারিণী তার এই ছেলের সঙ্গেই আমার রমার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। তখনও ত আর আমার যতীন জন্মায় নি—ভেবেছিল, যদু মুখুয্যের সমস্ত বিষয়টা তা হ’লে মুঠোর মধ্যে আস্‌বে—বুঝলে না বাবা বেণি! তা যখন হ’ল না, তখন ঐ ভৈরব আচায্যিকে দিয়ে কি সব জপতপ, তুক্‌তাক্‌ করিয়ে মায়ের কপালে আমার এমন আগুন ধরিয়ে দিলে যে, ছ’মাস পেরুল না, বাছার হাতের নোয়া, মাথার সিঁদুর ঘুচে গেল! ছোট জাত হ’য়ে চায় কিনা যদু মুখুয্যের মেয়েকে বৌ কর্‌তে! তেম্‌নি হারামজাদার মরণও হয়েছে—ব্যাটার হাতের আগুনটুকু পর্য্যন্ত পেলে না! ছোট-জাতের মুখে আগুন!” বলিয়া মাসী যেন কুস্তি শেষ করিয়া হাঁপাইতে লাগিলেন। পুনঃ পুনঃ ছোট জাতের উল্লেখে বেণীর মুখ ম্লান হইয়া গিয়াছিল, কারণ তারিণী ঘোষাল তাহারই খুড়া। রমা ইহা লক্ষ্য করিয়া মাসীকে তিরস্কারের কণ্ঠে কহিল, “কেন মাসি, তুমি মানুষের জাত নিয়ে কথা কও? জাত ত আর কারুর হাতেগড়া জিনিস নয়? যে যেখানে জন্মেচে সেই তার ভাল।” বেণী লজ্জিতভাবে একটুখানি হাসিয়া কহিল,—“না, রমা, মাসী ঠিক কথাই বলচেন। তুমি কত বড় কুলীনের মেয়ে, তোমাকে কি আমরা ঘরে আন্‌তে পারি বোন্‌! ছোট খুড়োর এ কথা মুখে আনাই বেয়াদপি। আর তুক্‌তাকের কথা যদি বল, ত’ সে সত্যি। দুনিয়ায় ছোট খুড়ো আর ঐ ব্যাটা ভৈরব আচায্যির অসাধ্য কাজ কিছু নেই। ঐ ভৈরব ত হয়েচে আজকাল রমেশের মুরুব্বি।”

মাসী কহিলেন—“সে ত জানা কথা বেণি! ছোঁড়া দশ বারো বচ্ছর ত দেশে আসেনি—এতদিন ছিল কোথায়?” “কি ক’রে জান্‌ব মাসি? ছোট খুড়োর সঙ্গে তোমাদেরও যে ভাব, আমাদেরও তাই। শুন্‌চি, এতদিন নাকি বোম্বাই, না, কোথায় ছিল। কেউ বল্‌চে, ডাক্তারি পাশ ক’রে এসেচে, কেউ বল্‌চে, উকিল হয়ে এসেচে—কেউ বল্‌চে, সমস্তই ফাঁকি—ছোঁড়া নাকি পাঁড় মাতাল! যখন বাড়ী এসে পৌঁছল, তখন দুই চোখ নাকি জবাফুলের মত রাঙা ছিল।” “বটে? তা হ’লে তাকে ত বাড়ী ঢুক্‌তে দেওয়াই উচিত নয়!” বেণী উৎসাহভরে মাথার একটা ঝাঁকানি দিয়া কহিল—“নয়ই ত! হাঁ রমা, তোমার রমেশকে মনে পড়ে?” নিজের হতভাগ্যের প্রসঙ্গ উঠিয়া পড়ায় রমা মনে মনে লজ্জা পাইয়াছিল। সলজ্জ মৃদু হাসিয়া কহিল,— “পড়ে বৈ কি। সে ত আমার চেয়ে বেশী বড় নয়। তা ছাড়া শীতলাতলার পাঠশালে দুজনেই পড়্‌তাম যে। কিন্তু তার মায়ের মরণের কথা আমার খুব মনে পড়ে। খুড়ীমা আমাকে বড় ভালবাস্‌তেন।” মাসী আর একবার নাচিয়া উঠিয়া বলিলেন,—“তার ভালবাসার মুখে আগুন! সে ভালবাসা কেবল নিজের কাজ হাসিল কর্‌বার জন্যে। তাদের মতলবই ছিল, তোকে কোনমতে হাত-করা।”

বেণী অত্যন্ত বিজ্ঞের মত সায় দিয়া কহিল, “তাতে আর সন্দেহ কি মাসি! ছোট খুড়ীমাও যে,—“কিন্তু তাহার বক্তব্য শেষ না হইতেই রমা অপ্রসন্নভাবে মাসীকে বলিয়া উঠিল,—“সে সব পুরণো কথায় দরকার নেই মাসি?”

রমেশের পিতার সহিত রমার যত বিবাদই থাক, তাহার জননীর সম্বন্ধে রমার কোথায় একটু যেন প্রচ্ছন্ন বেদনা ছিল। এতদিনেও তাহা সম্পূর্ণ তিরোহিত হয় নাই। বেণী তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া বলিলেন,—“তা বটে, তা বটে। ছোটখুড়ী ভালমানুষের মেয়ে ছিলেন। মা আজও তাঁর কথা উঠ্‌লে চোখের জল ফেলেন।”

কি কথায় কি কথা আসিয়া পড়ে দেখিয়া বেণী তৎক্ষণাৎ এসকল প্রসঙ্গ চাপা দিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, “তবে এই ত স্থির রইল দিদি, নড়চড় হবে না ত?” রমা হাসিল। কহিল, “বড়দা, বাবা বল্‌তেন, আগুনের শেষ, ঋণের শেষ, আর শত্রুর শেষ কখনো রাখিস্‌নে মা। তারিণী ঘোষাল জ্যান্তে আমাদের কম জ্বালা দেয়নি—বাবাকে পর্য্যন্ত জেলে দিতে চেয়েছিল। আমি কিছুই ভুলিনি বড়দা,—যতদিন বেঁচে থাক্‌ব, ভুল্‌ব না। রমেশ সেই শত্রুরই ছেলে ত! তা ছাড়া আমার ত কিছুতেই যাবার জো নেই। বাবা আমাদের দুই ভাইবোন্‌কে বিষয় ভাগ ক’রে দিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু সমস্ত বিষয় রক্ষা কর্‌বার ভার শুধু আমারই উপর যে! আমার ত নয়-ই, আমাদের সংস্রবে যারা আছে, তাদের পর্যন্ত যেতে দেব না।” একটু ভাবিয়া কহিল, “আচ্ছা বড়দা, এমন কর্‌তে পার না যে, কোনও ব্রাহ্মণ না তাদের বাড়ী যায়?” বেণী একটু সরিয়া আসিয়া গলা খাটো করিয়া বলিল, “সেই চেষ্টাই ত কর্‌চি বোন্‌। তুই আমার সহায় থাকিস্‌, আর আমি কোনও চিন্তে করিনে। রমেশকে এই কুঁয়াপুর থেকে না তাড়াতে পারি ত আমার নাম বেণী ঘোষাল নয়। তার পরে রইলাম আমি, আর ঐ ভৈরব আচায্যি! আর তারিণী ঘোষাল নেই; দেখি এ ব্যাটাকে এখন কে রক্ষা করে!” রমা কহিল, “রক্ষে কর্‌বে রমেশ ঘোষাল। দেখো বড়দা, এই আমি ব’লে রাখ্‌লুম, শত্রুতা কর্‌তে এও কম কর্‌বে না।” বেণী আরও একটু অগ্রসর হইয়া এক্‌বার এদিক্‌-ওদিক্‌ নিরীক্ষণ করিয়া লইয়া চৌকাঠের উপর উঁচু হইয়া বসিলেন। তারপরে কণ্ঠস্বর অত্যন্ত মৃদু করিয়া বলিলেন, “রমা, বাঁশ নুইয়ে ফেল্‌তে চাও ত, এই বেলা। পেকে গেলে আর হবে না, তা নিশ্চয় ব’লে দিচ্চি। বিষয়-সম্পত্তি কি ক’রে রক্ষে কর্‌তে হয় শেখেনি—এর মধ্যে যদি না শত্রুকে নির্ম্মূল করতে পারা যায়, ত ভবিষ্যতে আর যাবে না; এই কথাটা আমাদের দিবারাত্রি মনে রাখ্‌তে হবে যে, এ তারিণী ঘোষালেরই ছেলে—আর কেউ নয়!” “সে আমি বুঝি বড়দা!” “তুই না বুঝিস্‌ কি দিদি! ভগবান্‌ তোকে ছেলে গড়্‌তে গড়্‌তে মেয়ে গড়ে ছিলেন বৈ ত নয়। বুদ্ধিতে একটা পাকা জমিদারও তোর কাছে হটে যায়, এ কথা আমরা সবাই বলাবলি করি। আচ্ছা, কা’ল একবার আস্‌ব। আজ বেলা হ’ল যাই—” বলিয়া বেণী উঠিয়া পড়িলেন। রমা এই প্রশংসায় অত্যন্ত প্রীত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বিনয়-সহকারে কি একটু প্রতিবাদ করিতে গিয়াই তাহার বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করিয়া উঠিল। প্রাঙ্গণের এক প্রান্ত হইতে অপরিচিত গম্ভীর-কণ্ঠের আহ্বান আসিল—“রাণী, কই রে?” রমেশের মা এই নামে ছেলেবেলায় তাহাকে ডাকিতেন। সে নিজেই এতদিন তাহা ভুলিয়া গিয়াছিল। বেণীর প্রতি চাহিয়া দেখিল, তাহার সমস্ত মুখ কালীবর্ণ হইয়া গিয়াছে। পরক্ষণেই রুক্ষমাথা, খালি পা, উত্তরীয়টা মাথায় জড়ানো—রমেশ আসিয়া দাঁড়াইল। বেণীর প্রতি চোখ পড়িবামাত্র বলিয়া উঠিল, “এই যে বড়দা, এখানে? বেশ, চলুন, আপনি না হ’লে কর্‌বে কে? আমি সারা গাঁ আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্চি! কৈ রাণী কোথায়?” বলিয়াই কবাটের সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল। পলাইবার উপায় নাই, রমা ঘাড় হেঁট করিয়া রহিল। রমেশ মুহুর্ত্তমাত্র তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া মহাবিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিয়া উঠিল—“এই যে! আরে ইস্‌, কত বড় হয়েছিস রে? ভাল আছিস্‌?” রমা তেম্‌নি অধোমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। হঠাৎ কথা কহিতেই পারিল না। কিন্তু রমেশ একটুখানি হাসিয়া তৎক্ষণাৎ কহিল, “চিন্‌তে পাচ্ছিস্‌ ত রে? আমি তোদের রমেশ দা!” এখনও রমা মুখ তুলিয়া চাহিতে পারিল না। কিন্তু, মৃদু-কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, “আপনি ভাল আছেন?”

“হাঁ ভাই, ভাল আছি। কিন্তু, আমাকে ‘আপনি’ কেন রমা?” বেণীর দিকে চাহিয়া একটুখানি মলিন হাসি হাসিয়া বলিল, “রমার সেই কথাটা আমি কোন দিন ভুল্‌তে পারিনি বড়দা! যখন মা মারা গেলেন, ও তখন ত খুব ছোট। সেই বয়সেই আমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘রমেশদা, তুমি কেঁদ না, আমার মাকে আমরা দু’জনে ভাগ ক’রে নেব।’ তোর সে কথা বোধ করি মনে পড়ে না রমা, না? আচ্ছা, আমার মাকে মনে পড়ে ত?” কথাটা শুনিয়া রমার ঘাড় যেন লজ্জায় আরও ঝুঁকিয়া পড়িল। সে একটিবারও ঘাড় নাড়িয়া জানাইতে পারিল না যে, খুড়ীমাকে তাহার খুব মনে পড়ে। রমেশ বিশেষ করিয়া রমাকে উদ্দেশ করিয়াই বলিতে লাগিল—“আর ত সময় নেই, মাঝে শুধু তিনটি দিন বাকি, যা কর্‌বার ক’রে দাও ভাই, যাকে বলে একান্ত নিরাশ্রয়, আমি তাই হয়েই তোমাদের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েচি। তোমরা না গেলে এতটুকু ব্যবস্থা পর্য্যন্তও কর্‌তে পার্‌চি না।”

মাসী আসিয়া নিঃশব্দে রমেশের পিছনে দাঁড়াইলেন। বেণী অথবা রমা কেহই যখন একটা কথারও জবাব দিল না, তখন তিনি সুমুখের দিকে সরিয়া আসিয়া রমেশের মুখপানে চাহিয়া বলিলেন, “তুমি বাপু, তারিণী ঘোষালের ছেলে না?” রমেশ এই মাসীটিকে ইতিপূর্ব্বে দেখেন নাই; কারণ, সে গ্রামত্যাগ করিয়া যাইবার পরে ইনি রমার জননীর অসুখের উপলক্ষ্যে সেই যে মুখুয্যে বাড়ী ঢুকিয়াছিলেন, আর বাহির হন নাই। রমেশ কিছু বিস্মিত হইয়াই তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিল। মাসী বলিলেন, “না হ’লে এমন বেহায়া পুরুষমানুষ আর কে হবে? যেমন বাপ তেমনি ব্যাটা। বলা নেই, কহা নেই, একটা গেরস্তর বাড়ীর ভেতর ঢুকে উৎপাত করতে সরম হয় না তোমার?” রমেশ বুদ্ধিভ্রষ্টের মত কাঠ হইয়া চাহিয়া রহিল। “আমি চললুম” বলিয়া বেণী ব্যস্ত হইয়া সরিয়া পড়িলেন। রমা ঘরের ভিতর হইতে বলিল, “কি বোক্‌চ মাসী, তুমি নিজের কাজে যাও না—” মাসী মনে করিলেন, তিনি বোনঝির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটা বুঝিলেন। তাই কণ্ঠস্বরে আরও একটু বিষ মিশাইয়া কহিলেন, “নে, রমা, বকিস্‌নে। যে কাজ করতেই হবে, তাতে আমার তোদের মত চক্ষুলজ্জা হয় না। বেণীর অমন ভয়ে পালানর কি দরকার ছিল? ব’লে গেলেই ত হ’ত, আমরা বাপু তোমার গমস্তাও নই, খাস্‌ তালুকের প্রজাও নই যে, তোমার কর্ম্মবাড়ীতে জল তুল্‌তে, ময়দা মাখ্‌তে যাবো। তারিণী মরেচে, গাঁ শুদ্ধ লোকের হাড় জুড়িয়েচে; এ কথা আমাদের ওপর বরাত দিয়ে না গিয়ে নিজে ওর মুখের ওপর ব’লে গেলেই ত পুরুষ-মানুষের মত কাজ হ’ত।” রমেশ তখনও নিস্পন্দ অসাড়ের মত দাঁড়াইয়া রহিল। বস্তুতঃই এ-সকল কথা তাহার একান্ত দুঃস্বপ্নেরও অগোচর ছিল। ভিতর হইতে রান্নাঘরে কবাটের শিকলটা ঝন্‌ঝন্‌ করিয়া নড়িয়া উঠিল। কিন্তু কেহই তাহাতে মনোযোগ করিল না। মাসী রমেশের নির্ব্বাক ও অত্যন্ত পাংশুবর্ণ মুখের প্রতি চাহিয়া পুনরপি বলিলেন, “যাই হোক, বামুনের ছেলেকে আমি চাকর দরওয়ান দিয়ে অপমান করাতে চাইনে,—একটু হুঁস করে কাজ কর বাপু,—যাও। কচি খোকাটি নও যে, ভদ্দরলোকের বাড়ীর ভেতর ঢুকে আবদার ক’রে বেড়াবে! তোমার বাড়িতে আমার রমা কখন পা ধুতেও যেতে পারবে না, এই তোমাকে আমি ব’লে দিলুম।”

হঠাৎ রমেশ যেন নিদ্রোত্থিতের মত জাগিয়া উঠিল, এবং পরক্ষণেই তাহার বিস্তৃত বক্ষের ভিতর হইতে এম্‌নি গভীর একটা নিঃশ্বাস বাহির হইয়া আসিল যে, সে নিজেও সেই শব্দে সচকিত হইয়া উঠিল। ঘরের ভিতর কবাটের অন্তরালে দাঁড়াইয়া রমা মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল। রমেশ একবার বোধ করি ইতস্ততঃ করিল, তাহার পরে, রান্নাঘরের দিকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, “যখন যাওয়া হতেই পারে না, তখন আর উপায় কি! কিন্তু আমি ত এত কথা জান্‌তাম না—না জেনে যে উপদ্রব ক’রে গেলাম, সেজন্য আমাকে মাপ কোরো রাণি!” বলিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। ঘরের ভিতর হইতে এতটুকু সাড়া আসিল না। যাহার কাছে ক্ষমা-ভিক্ষা করা হইল, সে যে অলক্ষ্যে নিঃশব্দে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, রমেশ তাহা জানিতেও পারিল না। বেণী তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। সে পলায় নাই, বাহিরে লুকাইয়া অপেক্ষা করিতেছিল মাত্র। মাসীর সহিত চোখাচোখি হইতেই তাহার সমস্ত মুখ আহ্লাদে ও হাসিতে ভরিয়া গেল, সরিয়া আসিয়া কহিল, “হাঁ, শোনালে বটে মাসি! আমার সাধ্যিই ছিল না অমন ক’রে বলা! এ কি চাকর-দরোয়ানের কাজ রমা! আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখ্‌লাম কি না, ছোঁড়া মুখখানা যেন আষাঢ়ের মেঘের মত ক’রে বা’র হয়ে গেল! এই ত—ঠিক হ’ল!” মাসী ক্ষুণ্ণ অভিমানের সুরে বলিলেন, “খুব ত হ’ল জানি; কিন্তু এই দুটো মেয়েমানুষের ওপর ভার না দিয়ে, না স’রে গিয়ে নিজে ব’লে গেলেই ত আরও ভাল হ’ত! আর নাই যদি বল্‌তে পার্‌তে আমি কি বল্‌লুম তাকে, দাঁড়িয়ে থেকে শুনে গেলে না কেন বাছা? অমন স’রে পড়া উচিত কাজ হয়নি!” মাসীর কথার ঝাঁজে বেণীর মুখের হাসি মিলাইয়া গেল। সে যে এই অভিযোগের কি সাফাই দিবে, তাহা ভাবিয়া পাইল না, কিন্তু অধিকক্ষণ ভাবিতে হইল না, হঠাৎ রমা ভিতর হইতে তাহার জবাব দিয়া বসিল; এতক্ষণ সে একটি কথাও কহে নাই। কহিল, “তুমি যখন নিজে বলেছ মাসি, তখন সেই ত সকলের চেয়ে ভাল হয়েচে। যে যতই বলুক না কেন, এতখানি বিষ জিভ দিয়ে ছড়াতে তোমার মত কেউ ত পেরে উঠ্‌ত না!” মাসী এবং বেণী উভয়েই যার-পর-নাই বিস্ময়াপন্ন হইয়া উঠিলেন। মাসী রান্নাঘরের দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “কি বল্‌লি লা?” “কিছু না। আহ্নিক কর্‌তে বসে ত সাতবার উঠ্‌লে—যাও না, ওটা সেরে ফেল না—রান্নাবান্না কি হবে না?” বলিতে বলিতে রমা নিজেও বাহির হইয়া আসিল এবং কাহাকেও কোন কথা না বলিয়া বারান্দা পার হইয়া ও দিকের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল। বেণী শুষ্কমুখে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল, “ব্যাপার কি মাসি?” “কি ক’রে জান্‌ব বাছা? ও রাজ-রাণীর মেজাজ বোঝা কি আমাদের দাসীবাঁদীর কর্ম্ম?” বলিয়া ক্রোধে, ক্ষোভে, তিনি মুখখানা কালীবর্ণ করিয়া তাঁহার পূজার আসনে গিয়া উপবেশন করিলেন, এবং বোধ করি বা মনে মনে ভগবানের নাম করিতেই লাগিলেন। বেণী ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল।

এই কুঁয়াপুরের বিষয়টা অর্জ্জিত হইবার একটু ইতিহাস আছে, তাহা এইখানে বলা আবশ্যক। প্রায় শতবর্ষ পূর্ব্বে মহাকুলীন বলরাম মুখুয্যে, তাঁহার পিতা বলরাম ঘোষালকে সঙ্গে করিয়া, বিক্রমপুর হইতে এদেশে আসেন। মুখুয্যে শুধু কুলীন ছিলেন না, বুদ্ধিমান্‌ও ছিলেন। বিবাহ করিয়া বর্দ্ধমান রাজসরকারে চাক্‌রি করিয়া, এবং আরও কি কি করিয়া, এই বিষয়টুকু হস্তগত করেন। ঘোষালও এই দিকেই বিবাহ করেন। কিন্তু পিতৃঋণ শোধ করা ভিন্ন আর তাঁহার কোন ক্ষমতাই ছিল না; তাই, দুঃখে কষ্টেই তাঁহার দিন কাটিতেছিল। এই বিবাহ উপলক্ষ্যেই নাকি দুই মিতায় মনোমালিন্য ঘটে। পরিশেষে তাহা এমন বিবাদে পরিণত হয় যে, এক গ্রামে বাস করিয়াও বিশ বৎসরের মধ্যে কেহ কাহারও মুখদর্শন করেন নাই। বলরাম মুখুয্যে যে দিন মারা গেলেন, সে দিনেও ঘোষাল তাঁহার বাটীতে পা দিলেন না। কিন্তু তাঁহার মরণের পরদিন অতি আশ্চর্য্য কথা শুনা গেল। তিনি নিজেই সমস্ত বিষয় চুল-চিরিয়া অর্ধেক ভাগ করিয়া নিজের পুত্র ও পিতার পুত্রগণকে দিয়া গিয়াছেন। সেই অবধি এই কুঁয়াপুরের বিষয় মুখুয্যে ও ঘোষালবংশ ভোগদখল করিয়া আসিতেছে। ইঁহারা নিজেরাও জমিদার বলিয়া অভিমান করিতেন, গ্রামের লোকও অস্বীকার করিত না। যখনকার কথা বলিতেছি, তখন ঘোষালবংশও ভাগ হইয়াছিল। সেই বংশের ছোট-তরফের তারিণী ঘোষাল মকদ্দমা-উপলক্ষ্যে জেলায় গিয়া দিন ছয়েক পূর্ব্বে হঠাৎ যে দিন, আদালতের ছোটবড় পাঁচসাতটা মুলতুবি মকদ্দমায় শেষফলের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করিয়া, কোথাকার কোন্‌ অজানা আদালতের মহামান্য শমন মাথায় করিয়া নিঃশব্দে প্রস্থান করিলেন, তখন তাঁহাদের কুঁয়াপুর গ্রামের ভিতরে ও বাহিরে একটা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। বড়-তরফের কর্ত্তা বেণী ঘোষাল খুড়ার মৃত্যুতে গোপনে আরামের নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিলেন, এবং আরও গোপনে দল পাকাইতে লাগিলেন, কি করিয়া খুড়ার আগামী শ্রাদ্ধের দিনটা পণ্ড করিয়া দিবেন। দশ বৎসর খুড়া-ভাইপোয় মুখ দেখাদেখি ছিল না। বহু বৎসর পূর্ব্বে তারিণীর গৃহ শূন্য হইয়াছিল। সেই অবধি পুত্র রমেশকে তাহার মামার বাড়ী পাঠাইয়া দিয়া তারিণী বাটীর ভিতরে দাসদাসী এবং বাহিরে মকদ্দমা লইয়াই কাল কাটাইতেছিলেন। রমেশ রুড়কি-কলেজে এই দুঃসংবাদ পাইয়া পিতার শেষ-কর্ত্তব্য সম্পন্ন করিতে সুদীর্ঘকাল পরে কাল’ অপরাহ্নে তাহার শূন্যগৃহে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল।

কর্ম্মবাড়ী। মধ্যে শুধু দুটো দিন বাকী। বৃহস্পতিবারে রমেশের পিতৃশ্রাদ্ধ। দুই একজন করিয়া ভিন্ন গ্রামের মরুব্বিরা উপস্থিত হইতেছেন। কিন্তু নিজেদের কুঁয়াপুরের কেন যে কেহ আসে না, রমেশ তাহা বুঝিয়াছিল,—হয় ত, শেষ পর্য্যন্ত কেহ আসিবেই না, তাহাও জানিত। শুধু ভৈরব আচার্য্য ও তাহার বাড়ীর লোকেরা আসিয়া কাজকর্ম্মে যোগ দিয়াছিল। স্বগ্রামস্থ ব্রাহ্মণদিগের পদধূলির আশা না থাকিলেও, উদ্যোগ-আয়োজন রমেশ বড়লোকের মতই করিতেছিল। আজ অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত রমেশ বাড়ীর ভিতরে কাজকর্ম্মে ব্যস্ত ছিল। কি জন্যে বাহিরে আসিতেই দেখিল, ইতিমধ্যে জন-দুই প্রাচীন ভদ্রলোক আসিয়া, বৈঠকখানার বিছানায় সমাগত হইয়া ধূমপান করিতেছেন। সম্মুখে আসিয়া সবিনয়ে কিছু বলিবার পূর্ব্বেই, পিছনে শব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দেখিল, এক অতি বৃদ্ধ ৫।৬টি ছেলেমেয়ে লইয়া কাসিতে কাসিতে বাড়ী ঢুকিলেন। তাঁহার কাঁধের উপর মলিন উত্তরীয়, নাকের উপর একযোড়া ভাঁটার মত মস্ত চস্‌মা,—পিছনে দড়ি দিয়া বাঁধা শাদা চুল, শাদা গোঁফ—তামাকের ধুঁয়ায় তাম্রবর্ণ। অগ্রসর হইয়া আসিয়া তিনি সেই ভীষণ চস্‌মার ভিতর দিয়া রমেশের মুখের দিকে মুহূর্ত্তকাল চাহিয়া বিনা বাক্যব্যয়ে কাঁদিয়া ফেলিলেন। রমেশ চিনিল না ইনি কে, কিন্তু যেই হোন্‌, ব্যস্ত হইয়া কাছে আসিয়া তাঁহার হাত ধরিতেই, তিনি ভাঙা-গলায় বলিয়া উঠিলেন,—“না বাবা রমেশ, তারিণী যে এমন ক’রে ফাঁকি দিয়ে পালাবে, তা স্বপ্নেও জানিনে, কিন্তু আমারও এমন চাটুয্যে–বংশে জন্ম নয় যে, কারু ভয়ে মুখ দিয়ে মিথ্যা কথা বেরুবে। আসবাব সময় তোমার বেণী ঘোষালের মুখের সাম্‌নে ব’লে এলুম, আমাদের রমেশ যেমন শ্রাদ্ধের আয়োজন কর্‌চে, এমন করা চুলোয় যাক্‌, এ অঞ্চলে কেউ চোখেও দেখেনি।” একটু থামিয়া বলিলেন, “আমার নামে অনেক শালা অনেক রকম ক’রে তোমার কাছে লাগিয়ে যাবে বাবা’, কিন্তু এটা নিশ্চয় জেনো, এই ধর্ম্মদাস শুধু ধর্ম্মেরই দাস,আর কারো নয়।” এই বলিয়া বৃদ্ধ সত্য-ভাষণের সমস্ত পৌরুষ আত্মসাৎ করিয়া লইয়া, গোবিন্দ গাঙ্গুলীর হাত হইতে হুঁকাটা ছিনিয়া লইয়া তাহাতে এক টান্‌ দিয়াই প্রবলবেগে কাসিয়া ফেলিলেন।

ধর্ম্মদাস নিতান্ত অত্যুক্তি করে নাই। উদ্যোগ-আয়োজন যেরূপ হইতেছিল, এদিকে সেরূপ কেহ করে নাই। কলিকাতা হইতে ময়রা আসিয়াছিল, তাহারা প্রাঙ্গণের একধারে ভিয়ান চড়াইয়াছিল। সেদিকে পাড়ার কতকগুলা ছেলেমেয়ে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। কাঙ্গালীদের বস্ত্র দেওয়া হইবে। চণ্ডীমণ্ডপের ও-ধারের বারান্দায় অনুগত ভৈরব আচার্য্য থান ফাড়িয়া পাট করিয়া, গাদা করিতেছিল—সে দিকেও জনকয়েক লোক থাবা পাতিয়া বসিয়া এই অপব্যয়ের পরিমাণ হিসাব করিয়া, মনে মনে রমেশের নির্ব্বুদ্ধিতার জন্য তাহাকে গালি পাড়িতেছিল। গরীব-দুঃখী সংবাদ পাইয়া অনেক দূরের পথ হইতেও আসিয়া জুটিতেছিল। লোকজন, প্রজাপাঠক বাড়ী পরিপূর্ণ করিয়া, কেহ কলহ করিতেছিল, কেহ বা মিছামিছি শুধু কোলাহল করিতেছিল। চারিদিকে চাহিয়া ব্যয়বাহুল্য দেখিয়া, ধর্ম্মদাসের কাসি আরও বাড়িয়া গেল।

প্রত্যুত্তরে রমেশ সঙ্কুচিত হইয়া ‘না না’ বলিয়া আরও কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু ধর্ম্মদাস হাত নাড়িয়া থামাইয়া দিয়া ঘড় ঘড় করিয়া কত কি বলিয়া ফেলিলেন; কিন্তু কাসির ধমকে তাহার একটি বর্ণও বুঝা গেল না।

গোবিন্দ গাঙ্গুলী সর্ব্বাগ্রে আসিয়াছিলেন। সুতরাং ধর্ম্মদাস যাহা বলিয়াছিল, তাহা বলিবার সুবিধা তাঁহারই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক থাকিয়াও নষ্ট হইয়াছে ভাবিয়া তাঁহার মনে মনে ভারি একটা ক্ষোভ জন্মিতেছিল। তিনি এ সুযোগ আর নষ্ট হইতে দিলেন না। ধর্ম্মদাসকে উদ্দেশ করিয়া তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন,—“কা’ল সকালে, বুঝ্‌লে ধর্ম্মদাসদা, এখানে আস্‌ব ব’লে বেরিয়েও আসা হ’ল না—বেণীর ডাকাডা—‘গোবিন্দ খুড়ো, তামাক খেয়ে যাও।’ একবার ভাবলুম, কাজ নেই—তার পরে মনে হ’ল, ভাবখানা বেণীর দেখেই যাই না। বেণী কি বল্‌লে, জান বাবা রমেশ! বলে, খুড়ো, বলি তোমরা ত রমেশের মুরুব্বি হয়ে দাঁড়িয়েচ’, কিন্তু জিজ্ঞেস করি, লোকজন খাবে-টাবে ত?

আমি বা ছাড়ি কেন? তুমি বড়লোক আছ না আছ, আমার রমেশও কারো চেয়ে খাটো নয়—তোমার ঘরে ত এক মুঠো চিঁড়ের পিত্যেশ কারু নেই।—বললুম, বেণীবাবু, এই ত পথ, একবার কাঙ্গালী বিদেয়টা দাঁড়িয়ে দেখো।’ কালকের ছেলে রমেশ, কিন্তু বুকের পাটা ত বলি একে! এতটা বয়েস হ’ল, এমন আয়োজন কখনও চোখে দেখিনি। কিন্তু, তাও বলি ধর্ম্মদাস দা, আমাদের সাধ্যই বা কি! যাঁর কাজ তিনি উপর থেকে করাচ্চেন। তারিণী-দা শাপভ্রষ্ট দিক্‌পাল ছিলেন বৈ ত নয়!” ধর্ম্মদাসের কিছুতেই কাসি থামে না, সে কাসিতেই লাগিল, আর তাহার মুখের সাম্‌নে গাঙ্গুলী মশাই বেশ বেশ কথাগুলি অপরিপক্ক তরুণ জমিদারটিকে বলিয়া যাইতে লাগিলেন দেখিয়া, ধর্ম্মদাস আরও ভাল কিছু বলিবার চেষ্টায় যেন আকুলি-বিকুলি করিতে লাগিল।

গাঙ্গুলী বলিতে লাগিল, “তুমি ত আমার পর নও বাবা,—নিতান্ত আপনার। তোমার মা যে আমার একেবারে সাক্ষাৎ পিসতুত বোনের মামাত ভগিনী। রাধানগরের বাঁড়ুয্যে-বাড়ী—সে সব তারিণী দা’ জান্‌তেন। তাই যে কোন কাজকর্ম্মে—মামলা-মোকদ্দমা কর্‌তে, সাক্ষী দিতে—ডাক্‌ গোবিন্দকে!” ধর্ম্মদাস প্রাণপণবলে কাসি থামাইয়া খিঁচাইয়া উঠিলেন; “কেন, বাজে বকিস্ গোবিন্দ? খক্—খক্—খক্—আমি আজকের নয়—না জানি কি? সে বছর সাক্ষী দেবার কথায় বল্‌লি, ‘আমার জুতো নেই, খালি-পায়ে যাই কি ক’রে? খক্‌—খক্‌—তারিণী অম্‌নি আড়াই-টাকা দিয়ে একজোড়া জুতো কিনে দিল। তুই সেই পায়ে দিয়ে বেণীর হয়ে সাক্ষী দিয়ে এলি! খক্‌-খক্‌-খক্‌-খ—” গোবিন্দ চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া কহিল, “এলুম?”

“এলিনে?”

“দূর মিথ্যাবাদী!”

“মিথ্যাবাদী তোর বাবা!”

গোবিন্দ তাহার ভাঙা-ছাতি হাতে করিয়া লাফাইয়া উঠিল—“তবে রে শালা!”—ধর্ম্মদাস তাহার বাঁশের লাঠি উঁচাইয়া ধরিয়া হুঙ্কার দিয়াই প্রচণ্ডভাবে কাসিয়া ফেলিল। রমেশ শশব্যস্তে উভয়ের মাঝ্‌খানে আসিয়া পড়িয়া স্তম্ভিত হইয়া গেল। ধর্ম্মদাস লাঠি নামাইয়া কাসিতে কাসিতে বসিয়া পড়িয়া বলিল, “ও-শালার সম্পর্কে আমি বড়-ভাই হই কি না, তাই শালার আক্কেল দেখ—”

“ওঃ, শালা আমার বড় ভাই!” বলিয়া গোবিন্দ গাঙ্গুলীও ছাতি গুটাইয়া বসিয়া পড়িল।

সহরের ময়রারা ভিয়ান ছাড়িয়া চাহিয়া রহিল। চতুর্দ্দিকে যাহারা কাজকর্ম্মে নিযুক্ত ছিল, চেঁচামিচি শুনিয়া তাহারা তামাসা দেখিবার জন্য সুমুখে ছুটিয়া আসিল; ছেলেমেয়েরা খেলা ফেলিয়া হাঁ করিয়া মজা দেখিতে লাগিল; এবং এই সমস্ত লোকের দৃষ্টির সম্মুখে রমেশ লজ্জায়, বিস্ময়ে, হতবুদ্ধির মত স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার মুখ দিয়া একটাও কথা বাহিল হইল না। কি এ? উভয়েই প্রাচীন, ভদ্রলোক—ব্রাহ্মণ-সন্তান! এত সামান্য কারণে এমন ইতরের মত গালিগালাজ করিতে পারে? বারান্দায় বসিয়া ভৈরব কাপড়ের থাক্ দিতে দিতে সমস্তই দেখিতেছিল, শুনিতেছিল। এখন আসিয়া রমেশকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, “প্রায় শ’-চারেক কাপড় ত হ’ল, আরও চাই কি?” রমেশের মুখ দিয়া হঠাৎ কথাই বাহির হইল না। ভৈরব রমেশের অভিভূতভাব লক্ষ্য করিয়া হাসিল। মৃদু অনুযোগের স্বরে কহিল, “ছিঃ গাঙ্গুলী মশাই! বাবু একেবারে অবাক্‌ হয়ে গেছেন। আপনি কিছু মনে কর্‌বেন না বাবু, এমন ঢের হয়। বৃহৎ কাজকর্ম্মের বাড়ীতে কত ঠেঙা-ঠেঙি রক্তারক্তি পর্য্যন্ত হ’য়ে যায়—আবার যে-কে সেই হয়। নিন্‌ উঠুন, চাটুয্যে মশাই,—দেখুন দেখি, আরও থান ফাড়্‌ব কি না?” ধর্ম্মদাস জবাব দিবার পূর্ব্বেই গোবিন্দ গাঙ্গুলী সোৎসাহে শিরশ্চালনপূর্ব্বক খাড়া হইয়া বলিলেন, “হয়ই ত! হয়ই ত! ঢের হয়! নইলে বিরদ কর্ম্ম বলেচে কেন? শাস্তরে আছে, লক্ষ কথা না হলে বিয়েই হয় না যে! সে বছর তোমার মনে আছে ভৈরব, যদু মুখুয্যে মশায়ের কন্যা রমার গাছ পিতিষ্ঠের দিনে সিধে নিয়ে রাঘব ভট্‌চায্যিতে, হারাণ চাটুয্যেতে মাথা-ফাটাফাটি হ’য়ে গেল! কিন্তু আমি বলি ভৈরব ভায়া, বাবাজীর এ কাজটা ভাল হচ্চে না। ছোটলোকদের কাপড় দেওয়া, আর ভস্মে ঘি ঢালা এক কথা। তার চেয়ে বামুনদের একজোড়া, আর ছেলেদের একখানা ক’রে দিলেই নাম হ’ত। আমি বলি বাবাজী সেই যুক্তিই করুন, কি বল ধর্ম্মদাসদা?” ধর্ম্মদাস ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন, “গোবিন্দ মন্দ কথা বলেনি, বাবাজী! ও ব্যাটাদের হাজার দিলেও নাম হবার জো নেই। নইলে আর ওদের ছোটলোক বলেছে কেন? বুঝলে না বাবা রমেশ?” এখন পর্য্যন্ত রমেশ নিঃশব্দে ছিল। এই বস্ত্র-বিতরণের আলোচনায় সে একেবারে যেন মর্ম্মাহত হইয়া পড়িল। ইহার সুযুক্তি-কুযুক্তি সম্বন্ধে নহে; এখন এইটাই তাহার সর্ব্বাপেক্ষা অধিক বাজিল যে, ইহারা যাহাদিগকে ছোটলোক বলিয়া ডাকে, তাহাদেরই সহস্র চক্ষুর সম্মুখে এইমাত্র যে এত বড় একটা লজ্জাকর কাণ্ড করিয়া বসিল, সে জন্য ইহাদের কাহারও মনে এতটুকু ক্ষোভ বা লজ্জার কণামাত্রও নাই। ভৈরব মুখপানে চাহিয়া আছে দেখিয়া, রমেশ সংক্ষেপে কহিল, “আরও দু’শ কাপড় ঠিক ক’রে রাখুন।” “তা নইলে কি হয়? ভৈরব ভায়া, চল, আমিও যাই—তুমি একা আর কত পার্‌বে বল?” বলিয়া কাহারও সম্মতির অপেক্ষা না করিয়া গোবিন্দ উঠিয়া বস্ত্ররাশির নিকট গিয়া বসিল। রমেশ বাটীর ভিতর যাইবার উপক্রম করিতেই ধর্ম্মদাস তাহাকে একপাশে ডাকিয়া লইয়া চুপিচুপি অনেক কথা কহিল। রমেশ প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়িয়া সম্মতি-জ্ঞাপন করিয়া ভিতরে চলিয়া গেল। কাপড় গুছাইতে গুছাইতে গোবিন্দ গাঙ্গুলী আড়চোখে সমস্ত দেখিল। “কৈ গো, বাবাজী কোথায় গো?” বলিয়া একটি শীর্ণকায় মুণ্ডিতশ্মশ্রূ প্রাচীন ব্রাহ্মণ প্রবেশ করিলেন। ইহার সঙ্গেও গুটিতিনেক ছেলে-মেয়ে। মেয়েটি সকলের বড়। তাহারই পরণে শুধু একখানি অতি জীর্ণ ডুরে-কাপড়। বালক দু’টি কোমরে এক-একগাছি ঘুন্‌সি ব্যতীত একেবারে দিগম্বর। উপস্থিত সকলেই মুখ তুলিয়া চাহিল। গোবিন্দ অভ্যর্থনা করিল—“এস দীনুদা, বোসো। বড় ভাগ্যি আমাদের যে, আজ তোমার পায়ের ধূলো পড়্‌ল। ছেলেটা একা সারা হয়ে যায়, তা’ তোমরা—” ধর্ম্মদাস গোবিন্দের প্রতি কট্‌মট্‌ করিয়া চাহিল। সে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করিয়া কহিল, “তা তোমরা ত কেউ এ দিক্‌ মাড়াবে না, দাদা”—বলিয়া তাঁহার হাতে হুঁকাটা তুলিয়া দিল। দীনু ভট্‌চায আসন গ্রহণ করিয়া দগ্ধ হুঁকাটায় নিরর্থক গোটাদুই টান দিয়া বলিলেন, “আমি ত ছিলাম না ভায়া—তোমার বৌঠাক্‌রুণকে আন্‌তে তাঁর বাপের বাড়ী গিয়েছিলুম। বাবাজী কোথায়? শুন্‌চি নাকি ভারি আয়োজন হচ্চে? পথে আস্‌তে ও-গাঁয়ের হাটে শুনে এলুম, খাইয়ে-দাইয়ে ছেলে বুড়োর হাতে ষোলখানা ক’রে লুচি আর চার-জোড়া ক’রে সন্দেশ দেওয়া হবে।” গোবিন্দ গলা খাটো করিয়া কহিল, “তা’ ছাড়া হয় ত একখানা ক’রে কাপড়ও। এই যে রমেশ বাবাজী, তাই দীনুদা’কে বল্‌ছিলুম বাবাজী—তোমাদের পাঁচজনের বাপ-মায়ের আশীর্ব্বাদে যোগাড়-সোগাড় একরকম করা ত যাচ্চে, কিন্তু বেণী একেবারে উঠে পড়ে লেগেচে। এই আমার কাছেই দু’বার লোক পাঠিয়েছে। তা আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলে, রমেশের সঙ্গে আমার যেন নাড়ির টান্‌ রয়েচে; কিন্তু এই যে দীনু-দা, ধর্ম্মদাস-দা, এঁরাই কি, বাবা তোমাকে ফেল্‌তে পার্‌বেন? দীনু-দা ত পথ থেকে শুন্‌তে পেয়ে ছুটে আস্‌চেন। ওরে ও ষষ্ঠীচরণ, তামাক দে না রে! বাবা রমেশ, একবার এদিকে এস দেখি, একটা কথা ব’লে নিই!” নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া গোবিন্দ ফিস্‌ফিস্ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ভেতরে বুঝি ধর্ম্মদাস-গিন্নী এসেছে? খবরদার, খবরদার, অমন কাজটি কোরো না বাবা! বিট্‌লে বামুন যতই ফোস্‌লাক্‌, ধর্ম্মদাস-গিন্নীর হাতে ভাঁড়ারের চাবিটাবি দিয়ো না বাবা, কিছুতে দিয়ো না—ঘি, ময়দা, তেল, নুন অর্দ্ধেক সরিয়ে ফেল্‌বে। তোমার ভাবনা কি বাবা? আমি গিয়ে তোমার মামীকে পাঠিয়ে দেব। সে এসে ভাঁড়ারের ভার নেবে, তোমার একগাছি কুটো পর্যন্ত লোকসান্‌ হবে না।” রমেশ ঘাড় নাড়িয়া “যে আজ্ঞে” বলিয়া মৌন হইয়া রহিল। তাহার বিস্ময়ের অবধি নাই। ধর্ম্মদাস যে তাঁহার গৃহিণীকে ভাঁড়ারের ভার লইবার জন্য পাঠাইয়া দিবার কথা এত গোপনে কহিয়াছিল, গোবিন্দ ঠিক তাহাই আন্দাজ করিল কিরূপে?

উলঙ্গ শিশু-দুটো ছুটিয়া আসিয়া দীনু-দার কাঁধের উপর ঝুলিয়া পড়িল, “বাবা, সন্দেশ খাব।” দীনু একবার রমেশের প্রতি, একবার গোবিন্দের প্রতি চাহিয়া কহিল, “সন্দেশ কোথায় পাব রে?” “কেন, ঐ যে হচ্চে” বলিয়া তাহারা ওদিকের ময়রাদের দেখাইয়া দিল।

“আঁমরাও দাঁদামশাই”—বলিয়া নাকে কাঁদিতে কাঁদিতে আরও তিন-চারিটি ছেলে—মেয়ে ছুটিয়া আসিয়া বৃদ্ধ ধর্ম্মদাসকে ঘিরিয়া ধরিল। “বেশ ত, বেশ ত” বলিয়া রমেশ ব্যস্ত হইয়া অগ্রসর হইয়া আসিল, “ও আচায্যি মশাই, বিকেলবেলায় ছেলেরা সব বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, খেয়ে ত আসেনি; ওহে ও কি নাম তোমার? নিয়ে এস ত ঐ থালাটা এদিকে।” ময়রা সন্দেশের থালা লইয়া আসিবামাত্র ছেলেরা উপুড় হইয়া পড়িল; বাঁটিয়া দিবার অবকাশ দেয় না, এমনি ব্যস্ত করিয়া তুলিল। ছেলেদের খাওয়া দেখিতে দেখিতে দীননাথের শুষ্কদৃষ্টি সজল ও তীব্র হইয়া উঠিল—“ওরে ও খেঁদি, খাচ্চিস ত, সন্দেশ হয়েচে কেমন বল্‌ দেখি?” “বেশ বাবা।” বলিয়া খেঁদি চিবাইতে লাগিল। দীনু মৃদু হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, “হাঃ তোদের আবার পছন্দ! মিষ্টি হলেই হ’ল। হাঁ হে কারিকর, এ কড়াটা কেমন নামালে? কি বল, গোবিন্দ ভায়া, এখনো একটু রোদ আছে ব’লে মনে হচ্চে না?

ময়রা কোন দিকে না চাহিয়াই তৎক্ষণাৎ কহিল, “আজ্ঞে আছে বৈ কি! এখনো ঢের বেলা আছে, এখনো সন্ধ্যে আহ্নিকের—”

“তবে কৈ, দাও দেখি একটা গোবিন্দ ভায়াকে চেখে দেখুক, কেমন কল্‌কাতার কারিকর তোমরা! না, না, আমাকে আবার কেন? তবে আধখানা—আধখানার বেশী নয়। ওরে ও ষষ্ঠীচরণ, একটু জল আন্‌ দিকি বাবা, হাতটা ধুয়ে ফেলি—” রমেশ ডাকিয়া বলিয়া দিল, “অমনি বাড়ীর ভিতর থেকে গোটা-চারেক থালাও নিয়ে আসিস্‌ ষষ্ঠীচরণ।” প্রভুর আদেশমত ভিতর হইতে গোটাতিনেক রেকাবি ও জলের গেলাস আসিল এবং দেখিতে দেখিতে এই বৃহৎ থালার অর্দ্ধেক মিষ্টান্ন এই তিনটি প্রাচীন ম্যালেরিয়াক্লিষ্ট, কৃশ, সদ্‌ব্রাহ্মণের জলযোগে নিঃশেষিত হইয়া গেল। “হাঁ, কল্‌কাতার কারিকর বটে! কি বল ধর্ম্মদাসদা?” বলিয়া দীননাথ রুদ্ধনি:শ্বাস ত্যাগ করিলেন। ধর্ম্মদাস-দা’র তখনও শেষ হয় নাই, এবং যদিচ তাঁহার অব্যক্ত কণ্ঠস্বর সন্দেশের তাল ভেদ করিয়া সহজে মুখ দিয়া বাহির হইতে পারিল না, তথাপি বোঝা গেল, এ বিষয়ে তাঁহার মতভেদ নাই। “হাঁ, ওস্তাদি হাত বটে” বলিয়া গোবিন্দ সকলের শেষে হাত ধুইবার উপক্রম করিতেই ময়রা সবিনয়ে অনুরোধ করিল, “যদি কষ্টই করলেন ঠাকুর মশাই, তবে মিহিদানাটাও অমনি পরখ ক’রে দিন।” “মিহিদানা? কৈ, আন দেখি বাপু?” মিহিদানা আসিল এবং এতগুলি সন্দেশের পরে এই নূতন বস্তুটির সদ্ব্যবহার দেখিয়া রমেশ নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল! দীননাথ মেয়ের প্রতি হস্ত প্রসারিত করিয়া কহিলেন, “ওরে ও খেঁদি, ধর্ দিকি মা, এই দুটো মিহিদানা।” “আমি আর খেতে পার্‌ব না বাবা।” “পার্‌বি, পার্‌বি।” এক ঢোক জল খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নে দিকি, মুখ মেরে গেছে বৈ ত নয়! না পারিস্, আঁচলে একটা গেরো দিয়ে রাখ্, কা’ল সকালে খাস্। হাঁ বাপু, খাওয়ালে বটে! যেন অমৃত! তা’ বেশ হয়েচে। মিষ্টি বুঝি দুরকম কর্‌লে বাবাজী!” রমেশকে বলিতে হইল না। ময়রা সোৎসাহে কহিল, “আজ্ঞে না, রসগোল্লা, ক্ষীরমোহন—”

“অ্যাঁ, ক্ষীরমোহন! কৈ, সে ত বা’র করলে না বাপু?” বিস্মিত রমেশের মুখের পানে চাহিয়া দীননাথ কহিল, “খেয়েছিলুম বটে, রাধানগরের বোসেদের বাড়ীতে। আজও যেন মুখে লেগে রয়েচে। বল্‌লে বিশ্বাস করবে না বাবাজী, ক্ষীরমোহন খেতে আমি বড্ড ভালোবাসি।” রমেশ হাসিয়া একটুখানি ঘাড় নাড়িল। কথাটা বিশ্বাস করা তাহার কাছে অত্যন্ত কঠিন বলিয়া মনে হইল না। রাখাল কি কাজে বাহিরে যাইতেছিল। রমেশ তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “ভেতরে বোধ করি আচায্যিমশাই আছেন; যা ত রাখাল, কিছু ক্ষীরমোহন তাঁকে আন্‌তে ব’লে আয় দেখি।” সন্ধ্যা বোধ করি উত্তীর্ণ হইয়াছে। তথাপি ব্রাহ্মণেরা ক্ষীরমোহনের আশায় উৎসুক হইয়া বসিয়া আছেন। রাখাল ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “আজ আর ভাঁড়ারের চাবি খোলা হবে না বাবু।” রমেশ মনে মনে বিরক্ত হইল। কহিল, “বল্‌ গে, আমি আন্‌তে বল্‌ছি।”

গোবিন্দ গাঙ্গুলী রমেশের অসন্তোষ লক্ষ্য করিয়া চোক ঘুরাইয়া কহিল, “দখ্‌লে দীনু দা ভৈরবের আক্কেল? এ যে দেখি মায়ের চেয়ে মাসীর বেশী দরদ। সেইজন্যই, আমি বলি—” তিনি কি বলেন, তাহা না শুনিয়াই রাখাল বলিয়া উঠিল—“আচায্যিমশাই কি কর্‌বেন? ও-বাড়ী থেকে গিন্নীমা এসে ভাঁড়ার বন্ধ করেছেন যে!” ধর্ম্মদাস এবং গোবিন্দ উভয়ে চমকিয়া উঠিল—“কে, বড়-গিন্নী?” রমেশ সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, “জ্যাঠাইমা এসেছেন?” “আজ্ঞে হাঁ, তিনি এসেই ছোট বড় দুই ভাঁড়ারই তালাবন্ধ ক’রে ফেলেচেন।” বিস্ময়ে, আনন্দে, রমেশ দ্বিতীয় কথাটি না বলিয়া দ্রুতপদে ভিতরে চলিয়া গেল।

“জ্যাঠাইমা?” ডাক শুনিয়া বিশ্বেশ্বরী ভাঁড়ার ঘর হইতে বাহিরে আসিলেন। বেণীর বয়সের সঙ্গে তুলনা করিলে তাহার জননীর বয়স পঞ্চাশের কম হওয়া উচিত নয়; কিন্তু দেখিলে কিছুতেই চল্লিশের বেশী বলিয়া মনে হয় না। রমেশ নির্নিমেষচক্ষে চাহিয়া রহিল। আজও সেই কাঁচাসোনার বর্ণ। একদিন যে রূপের খ্যাতি এ অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল, আজও সেই অনিন্দ্য সৌন্দর্য্য তাঁহার নিটোল পরিপূর্ণ দেহটিকে বর্জ্জন করিয়া দূরে যাইতে পারে নাই। মাথার চুলগুলি ছোট করিয়া ছাঁটা, সুমুখের দুই একগাছি কুঞ্চিত হইয়া কপালের উপর পড়িয়াছে। চিবুক, কপোল, ওষ্ঠাধর, ললাট সবগুলি যেন কোন বড় শিল্পীর বহুযত্নের বহু সাধনার ফল। সব চেয়ে আশ্চর্য্য তাঁহার দুটি চক্ষুর দৃষ্টি। সেদিকে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিলে সমস্ত অন্তঃকরণ যেন মোহাবিষ্ট হইয়া আসিতে থাকে।

এই জ্যাঠাইমা রমেশকে এবং বিশেষ করিয়া তাহার পরলোকগতা জননীকে একসময় বড় ভালবাসিতেন। বধূ-বয়সে যখন ছেলেরা হয় নাই—শাশুড়ি-ননদের যন্ত্রণায় লুকাইয়া বসিয়া এই দু’টি জায়ে যখন একযোগে চোখের জল ফেলিতেন—তখন এই স্নেহের প্রথম গ্রন্থি-বন্ধন হয়। তার পরে, গৃহবিচ্ছেদ, মামলা-মকদ্দমা, পৃথক্‌-হওয়া, কত রকমের ঝড়ঝাপটা এই দুটি সংসারের উপর দিয়া বহিয়া গিয়াছে; বিবাদের উত্তাপে বাঁধন শিথিল হইয়াছে; কিন্তু, একেবারে বিচ্ছিন্ন হইতে পারে নাই। বহুবর্ষ পরে সেই ছোট বৌয়ের ভাঁড়ারঘরে ঢুকিয়া, তাহারি হাতের সাজানো এই সমস্ত বহু পুরাতন হাঁড়ি-কলসির পানে চাহিয়া, জ্যাঠাইমার চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছিল। রমেশের আহ্বানে যখন তিনি চোখ মুছিয়া বাহির হইয়া আসিলেন, তখন সেই দুটি আরক্ত আর্দ্র চক্ষু-পল্লবের পানে চাহিয়া রমেশ ক্ষণকালের জন্য বিস্ময়াপন্ন হইয়া রহিল। জ্যাঠাইমা তাহা টের পাইলেন। তাহাতেই, বোধ করি, এই সদ্য-পিতৃহীন রমেশের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেই তাঁহার বুকের ভিতরটা যেভাবে হাহাকার করিয়া উঠিল, তাহার লেশমাত্র তিনি বাহিরে প্রকাশ পাইতে দিলেন না। বরং একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, “চিনতে পারিস্‌, রমেশ?” জবাব দিতে গিয়া রমেশের ঠোঁট কাঁপিয়া গেল। মা মারা গেলে, যতদিন না সে মামার বাড়ী গিয়াছিল, ততদিন, এই জ্যাঠাইমা তাহাকে বুকে করিয়া রাখিয়াছিলেন এবং কিছুতে ছাড়িতে চাহেন নাই। সেও মনে পড়িল; এবং এও মনে হইল, সেদিন ওবাড়ীতে গেলে জ্যাঠাইমা বাড়ী নাই বলিয়া দেখা পর্য্যন্ত করেন নাই। তার পর, রমাদের বাটীতে বেণীর সাক্ষাতে এবং অসাক্ষাতে তাহার মাসীর নিরতিশয় কঠিন তিরস্কারে সে নিশ্চয় বুঝিয়া আসিয়াছিল, এ গ্রামে আপনার বলিতে তাহার আর কেহ নাই। বিশ্বেশ্বরী রমেশের মুখের প্রতি মুহূর্ত্তকাল চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “ছি, বাবা, এ সময়ে শক্ত হ’তে হয়।” তাঁহার কণ্ঠস্বরে কোমলতার আভাসমাত্র যেন ছিল না। রমেশ নিজেকে সামলাইয়া ফেলিল। সে বুঝিল, যেখানে অভিমানের কোন মর্য্যাদা নাই, সেখানে অভিমান প্রকাশ পাওয়ার মত বিড়ম্বনা সংসারে অল্পই আছে। কহিল, “শক্ত আমি হয়েচি, জ্যাঠাইমা! তাই যা পার্‌তুম, নিজেই করতুম; কেন তুমি আবার এলে? জ্যাঠাইমা হাসিলেন। কহিলেন, “তুই ত আমাকে ডেকে আনিস্‌নি, রমেশ, যে, তোকে তার কৈফিয়ৎ দেব? তা শোন্ বলি। কাজকর্ম্ম হবার আগে আর আমি ভাঁড়ার থেকে খাবার-টাবার কোনো জিনিস বা’র হ’তে দেব না। যাবার সময় ভাঁড়ারের চাবি তোর হাতেই দিয়ে যাব, আবার কা’ল এসে তোর হাত থেকেই নেব। আর কারু হাতে দিস্‌নি যেন! হাঁ রে, সে দিন তোর বড়দার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?” প্রশ্ন শুনিয়া রমেশ দ্বিধায় পড়িল। সে ঠিক বুঝিতে পারিল না, তিনি পুত্রের ব্যবহার জানেন কি না। একটু ভাবিয়া কহিল, “বড়দা তখন ৎ বাড়ী ছিলেন না।” প্রশ্ন করিয়াই জ্যাঠাইমার মুখের উপর একটা উদ্বেগের ছায়া আসিয়া পড়িয়াছিল; রমেশ স্পষ্ট দেখিতে পাইল, তাহার এই কথায় সেই ভাবটা যেন কাটিয়া গিয়া মুখখানি প্রসন্ন হইয়া উঠিল। হাসিমুখে, সস্নেহ-অনুযোগের কণ্ঠে বলিলেন, “আ আমার কপাল! এই বুঝি? হাঁ রে, দেখা হয়নি ব’লে আর যেতে নেই? আমি জানি রে, সে তোদের ওপর সন্তুষ্ট নয়; কিন্তু, তোর কাজ ত তোর করা চাই! যা, একবার ভাল ক’রে বল্‌গে যা, রমেশ! সে বড় ভাই, তার কাছে হেঁট হতে তোর কোন লজ্জা নেই। তা’ ছাড়া এটা মানুষের এম্‌নি দুঃসময় বাবা, যে, কোন লোকের হাতে পায়ে ধরে মিট্‌মাট ক’রে নিতেও লজ্জা নেই। লক্ষ্মী মাণিক আমার, যা একবার—এখন বোধ হয়, সে বাড়ীতেই আছে।” রমেশ চুপ করিয়া রহিল। এই আগ্রহাতিশয্যের হেতুও তাহার কাছে সুস্পষ্ট হইল না, মন হইতে সংশয়ও ঘুচিল না। বিশ্বেশ্বরী আরও কাছে সরিয়া আসিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, “বাইরে যাঁরা ব’সে আছেন, তাঁদের আমি তোর চেয়ে বেশি জানি। তাঁদের কথা শুনিস্‌নে। আর আমার সঙ্গে তোর বড়দার কাছে একবার যাবি চল্‌।” রমেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “না জ্যাঠাইমা, সে হবে না। আর বাইরে যাঁরা ব’সে আছেন, তাঁরা যাই হোন, তাঁরাই আমার সকলের চেয়ে আপনার।” সে আরও কি কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু হঠাৎ জ্যাঠাইমার মুখের প্রতি লক্ষ্য করিয়া সে মহাবিস্ময়ে চুপ করিল। তাহার মনে হইল, জ্যাঠাইমার মুখখানি যেন সহসা চারিদিকের সন্ধ্যার চেয়েও বেশি মলিন হইয়া গিয়াছে। খানিক পরে তিনি একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, তবে তাই। যখন তার কাছে যাওয়া হতেই পার্‌বে না, তখন আর সে নিয়ে কথা কয়ে কি হবে। যা হোক, তুই কিছু ভাবিস্‌নে বাবা, কিছুই আট্‌কাবে না। আমি আবার খুব ভোরেই আস্‌ব।” বলিয়া বিশ্বেশ্বরী তাঁহার দাসীকে ডাকিয়া লইয়া খিড়কির দ্বার দিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন। বেণীর সহিত রমেশের ইতিমধ্যে দেখা হইয়া যে একটা কিছু হইয়া গিয়াছে, তাহা তিনি বুঝিলেন। তিনি যে পথে চলিয়া গেলেন, সেই দিকে চাহিয়া কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া থাকিয়া, রমেশ ম্লানমুখে যখন বাহিরে আসিল, তখন গোবিন্দ ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বাবাজী, বড়গিন্নী এসেছিলেন না?” রমেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “হাঁ।” “শুন্‌লুম, ভাঁড়ার বন্ধ ক’রে চাবি নিয়ে গেলেন না।” রমেশ তেমনি মাথা নাড়িয়া জবাব দিল। কারণ, অবশেষে কি মনে করিয়া তিনি যাইবার সময় ভাঁড়ারের চাবি নিজেই লইয়া গিয়াছিলেন। “দেখলে ধর্ম্মদাস-দা, যা বলেচি তাই। বলি, মৎলবটা বুঝ্‌লে বাবাজী?” রমেশ মনে মনে অত্যন্ত ক্রূদ্ধ হইল। কিন্তু নিজের নিরুপায় অবস্থা স্মরণ করিয়া সহ্য করিয়া চুপ করিয়া রহিল। দরিদ্র দীনু ভট্‌চায তখনও যায় নাই। কারণ তাহার বুদ্ধি-শুদ্ধি ছিল না। সে ছেলে-মেয়ে লইয়া যাহার দয়ায় পেট ভরিয়া সন্দেশ খাইতে পাইয়াছিল, তাহাকে আন্তরিক দুটো আশীর্ব্বাদ না করিয়া, সকলের সম্মুখে উচ্চকণ্ঠে তাহার সাতপুরুষের স্তব-স্তুতি না করিয়া আর ঘরে ফিরিতে পারিতেছিল না। সে ব্রাহ্মণ নিরীহভাবে বলিয়া ফেলিল, “এ মৎলব বোঝা আর শক্ত কি ভায়া? তালাবন্ধ ক’রে চাবি নিয়ে গেচেন, তার মানে ভাঁড়ার আর কারো হাতে না পড়ে। তিনি সমস্তই ত জানেন।” গোবিন্দ বিরক্ত হইয়াছিল; নির্ব্বোধের কথায় জ্বলিয়া উঠিয়া তাহাকে একটা ধমক দিয়া কহিল, “বোঝো না, সোঝো না, তুমি কথা কও কেন বল ত। তুমি এ-সব ব্যাপারের কি বোঝ যে মানে কর্‌তে এসেচ?” ধমক খাইয়া দীনুর নির্ব্বুদ্ধিতা আরও বাড়িয়া গেল। সেও উষ্ণ হইয়া জবাব দিল, “আরে, এতে বোঝাবুঝিটা আছে কোনখানে? শুন্‌চ না, গিন্নী-মা স্বয়ং এসে বন্ধ ক’রে চাবি নিয়ে গেছেন? এতে কথা কইবে আবার কে?” গোবিন্দ আগুন হইয়া কহিল, “ঘরে যাও না ভট্‌চায। যে জন্যে ছুটে এসেছিলে—গুষ্টিবর্গ মিলে খেলে, বাঁধ্‌লে, আর কেন, ক্ষীরমোহন পরশু খেয়ো, আজ আর হবে না। এখন যাও আমাদের ঢের কাজ আছে।” দীনু লজ্জিত ও সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। রমেশ ততোধিক কুণ্ঠিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল। গোবিন্দ আরও কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সহসা রমেশের শান্ত অথচ কঠিন কন্ঠস্বরে থামিয়া গেল—“আপনার হ’ল কি গাঙুলীমশাই? যাকে-তাকে এমন খামকা অপমান কর্‌চেন কেন?” গোবিন্দ ভর্ৎসিত হইয়া প্রথমটা বিস্মিত হইল। কিন্তু পরক্ষণেই শুষ্ক-হাসি হাসিয়া বলিল, “অপমান আবার কাকে কর্‌লুম্‌ বাবাজী? ভাল, ওকেই জিজ্ঞাসা ক’রে দেখ না, ঠিক সত্যি কথাটি বলেচি কি না? ও ডালে-ডালে বেড়ায় ত আমি পাতায় পাতায় বেড়াই যে! দেখ্‌লে ধর্ম্মদাস-দা, দীনে বামনার আস্পর্দ্ধা? আচ্ছা—” ধর্মদাস-দা কি দেখিল, তাহা সেই জানে, কিন্তু রমেশ এই লোকটার নির্লজ্জতা ও স্পর্দ্ধা দেখিয়া অবাক্‌ হইয়া গেল। তখন দীনু রমেশের দিকে চাহিয়া নিজেই বলিল, “না বাবা, গোবিন্দ সত্য কথাই বলেচেন। আমি বড় গরীব, সে কথা সবাই জানে। ওঁদের মত আমার জমি-জমা চাষবাস কিছুই নেই। একরকম চেয়ে-চিন্তে ভিক্ষেসিক্ষে করেই আমাদের দিন চলে। ভালজিনিস ছেলেপিলেদের কিনে খাওয়াবার ক্ষমতা ত ভগবান্‌ দেননি—তাই, বড় ঘরে কাজকর্ম্ম হ’লে ওরা খেয়ে বাঁচে। কিন্তু মনে কোরো না, বাবা, তারিণীদাদা বেঁচে থাক্‌তে তিনি আমাদের খাওয়াতে বড় ভালবাস্‌তেন। তাই, আমি তোমাকে নিশ্চয় বল্‌চি বাবা, আমরা যে আশ মিটিয়ে খেয়ে গেলুম, তিনি ওপর থেকে, দেখে খুসীই হয়েচেন।” হঠাৎ দীনুর গভীর শুষ্ক চোখদুটো জলে ভরিয়া উঠিয়া, টপ্‌টপ্ করিয়া দুফোঁটা সকলের সুমুখেই ঝরিয়া পড়িল। রমেশ মুখ ফিরিয়া দাঁড়াইল। দীনু তাহার মলিন ও শতচ্ছিন্ন উত্তরীয়প্রান্তে অশ্রু মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, “শুধু আমিই নই বাবা! এদিকে আমার মত দুঃখী-গরীব যে যেখানে আছে, তারিণীদার কাছে, হাত পেতে কেউ কখনো অমনি ফেরেনি। সে কথা কে আর জানে বল? তাঁর ডান হাতের দান বাঁ হাতটাও টের পেত না যে! আর তোমাদের জ্বালাতন কর্‌ব না। নে, মা, খেঁদি ওঠ, হরিধন, চল্‌ বাবা ঘরে যাই, আবার কাল সকালে আস্‌ব, আর কি বল্‌ব বাবা রমেশ, বাপের মত হও, দীর্ঘজীবী হও।”

রমেশ তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে পথে আসিয়া আর্দ্রকন্ঠে কহিল, “ভট্‌চায্যি মশাই, এই দুটো তিনটে দিন আমার ওপর দয়া রাখ্‌বেন। আর বল্‌তে সঙ্কোচ হয়, কিন্তু এ বাড়ীতে হরিধনের মায়ের যদি পায়ের ধুলো পড়ে ত ভাগ্য ব’লে মনে কর্‌ব।” ভট্‌চায্যি মশায় ব্যস্ত হইয়া নিজের দুই হাতের মধ্যে রমেশের দুই হাত চাপিয়া ধরিয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিলেন, “আমি বড় দুঃখী, বাবা রমেশ, আমাকে এমন ক’রে বল্‌লে যে লজ্জায় ম’রে যাই।”

ছেলেমেয়ে সঙ্গে করিয়া বৃদ্ধ ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। রমেশ ফিরিয়া আসিয়া মুহূর্ত্তের জন্য নিজের রূঢ় কথা স্মরণ করিয়া গাঙুলী মশায়কে কিছু বলিবার চেষ্টা করিতেই, তিনি থামাইয়া দিয়া উদ্দীপ্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “এ যে আমার নিজের কাজ, রমেশ, তুমি না ডাক্‌লেও যে আমাকে নিজে এসেই সমস্ত কর্‌তে হ’ত। তাই ত এসেছি; ধর্ম্মদাস-দা’ আর আমি দুই ভায়ে ত তোমার ডাক্‌বার অপেক্ষা রাখিনি, বাবা।” ধর্ম্মদাস এইমাত্র তামাক খাইয়া কাসিতেছিল। লাঠিতে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া কাসির ধমকে চোখ-মুখ রাঙা করিয়া, হাত ঘুরাইয়া বলিল, “বলি শোন রমেশ, আমরা বেণী ঘোষাল নই। আমাদের জন্মের ঠিক আছে।” তাহার কুৎসিত কথায় রমেশ চম্‌কাইয়া উঠিল। কিন্তু আর রাগ করিল না। এই অত্যল্প সময়ের মধ্যেই সে বুঝিয়াছিল, ইহারা শিক্ষা ও অভ্যাসের দোষে অসঙ্কোচে কত বড় গর্হিত কথা যে উচ্চারণ করে, তাহা জানেও না।

জ্যাঠাইমার সস্নেহ অনুরোধে এবং তাঁহার ব্যথিত মুখ মনে করিয়া রমেশ ভিতরে ভিতরে পীড়া অনুভব করিতেছিল। সকলে প্রস্থান করিলে সে বড়দা’র কাছে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইল। বেণীর চণ্ডীমণ্ডপের বাহিরে আসিয়া যখন উপস্থিত হইল, তখন রাত্রি আটটা। ভিতরে যেন একটা লড়াই চলিতেছে। গোবিন্দ গাঙ্গুলীর হাঁকা-হাঁকিটাই সবচেয়ে বেশী। বাহির হইতেই তাহার কানে গেল, গোবিন্দ বাজি রাখিয়া বলিতেছে, “এ যদি না দু’দিনে উচ্ছন্ন যায়, ত আমার গোবিন্দ গাঙ্গুলী নাম তোমরা বদ্‌লে রেখো, বেণী বাবু! নবাবি কাণ্ডকারখানা শুন্‌লে ত? তারিণী ঘোষাল সিকি পয়সা রেখে মরেনি, তা’ জানি, তবে এত কেন? হাতে থাকে কর, না থাকে, বিষয় বন্ধক দিয়ে কে কবে ঘটা ক’রে বাপের ছাদ্দ করে, তা ত কখন শুনিনি, বাবা! আমি তোমাকে নিশ্চয় বল্‌চি, বেণীমাধব বাবু, এ ছোঁড়া নন্দীদের গদি থেকে অন্ততঃ তিনঢি হাজার টাকা দেনা ক’রেচে।” বেণী উৎসাহিত হইয়া কহিল, “তা হ’লে কথাটা ত বার ক’রে নিতে হচ্চে, গোবিন্দ খুড়ো?” গোবিন্দ স্বর মৃদু করিয়া বলিল, “সবুর কর না, বাবাজী! একবার ভাল করে ঢু্‌ক্‌তেই দাও না—তার পরে—বাইরে দাঁড়িয়ে কে ও? এ কি, রমেশ বাবাজী? আমরা থাক্‌তে এত রাত্তিরে তুমি কেন, বাবা?” রমেশ সে কথার জবাব না দিয়া অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিল, “বড়দা’, আপনার কাছেই এলুম।” বেণী থতমত খাইয়া জবাব দিতে পারিল না। গোবিন্দ তৎক্ষণাৎ কহিল, “আস্‌বে বৈ কি, বাবা, একশবার আস্‌বে! এ ত তোমারই বাড়ী। আর বড়ভাই পিতৃতুল্য। তাই ত আমরা বেণীবাবুকে বল্‌তে এসেছি, বেণীবাবু, তারিণীদার ওপর মনোমালিন্য তাঁর সঙ্গেই যাক্‌—আর কেন? তোমরা দু’ভাই এক হও, আমরা দেখে চোখ জুড়োই—কি বল, হালদারমামা? ও কি, দাঁড়িয়ে রইলে যে, বাবা—কে আছিস্‌ রে, একখানা কম্বলের আসন-টাসন পেতে দে না রে! না, বেণী বাবু, তুমি বড় ভাই—তুমিই সব। তুমি আলাদা হয়ে থাক্‌লে চলবে না। তা’ ছাড়া বড়গিন্নী ঠাক্‌রুন যখন স্বয়ং গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন, তখন—” বেণী চম্‌কাইয়া উঠিল—“মা গিয়ে ছিলেন?”

এই চমক্‌টা লক্ষ্য করিয়া গোবিন্দ মনে মনে খুসি হইল। কিন্তু, বাহিরে সে ভাব গোপন করিয়া নিতান্ত ভাল মানুষের মত খবরটা ফলাও করিয়া বলিতে লাগিল, “শুধু যাওয়া কেন, ভাঁড়ার-টাঁড়ার—করাকর্ম্ম যা’ কিছু তিনিই ত কর্‌চেন। আর তিনি না কর্‌লে কর্‌বেই বা কে?” সকলেই চুপ করিয়া রহিল। গোবিন্দ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “নাঃ—গাঁয়ের মধ্যে বড়গিন্নী ঠাক্‌রুনের মত মানুষ কি আর আছে?—না হবে? না বেণীবাবু, সাম্‌নে বল্‌লে খোসামোদ করা হবে, কিন্তু, যে যাই বলুক, গাঁয়ে যদি লক্ষ্মী থাকেন, ত সে তোমার মা। এমন মা কি কারু হয়?” বলিয়া পুনশ্চ একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া গম্ভীর হইয়া রহিলেন। বেণী অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অস্ফুটে কহিল,—“আচ্ছা—” গোবিন্দ চাপিয়া ধরিল, “শুধু আচ্ছা নয়, বেণীবাবু! যেতে হবে, কর্‌তে হবে, সমস্ত ভার তোমার উপরে। ভাল কথা, সবাই আপনারা ত উপস্থিত আছেন, নেমন্তন্নটা কি রকম করা হবে, একটা ফর্দ্দ ক’রে ফেলা হোক্‌ না কেন? কি বল, রমেশ বাবাজী? ঠিক্‌ কথা কি না, হালদার মামা! ধর্ম্মদাস-দা’ চুপ ক’রে রইলে কেন? কাকে বল্‌তে হবে, কাকে বাদ দিতে হবে, জান ত সব।”

রমেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সহজ-বিনীত-কন্ঠে বলিল, “বড়দা,’ একবার পায়ের ধুলো যদি দিতে পারেন—” বেণী গম্ভীর হইয়া কহিল, “মা যখন গেছেন, তখন আমার যাওয়া না যাওয়া—কি বল, গোবিন্দ খুড়ো?” গোবিন্দ কথা কহিবার পূর্ব্বেই রমেশ বলিল, “আপনাকে আমি পীড়াপীড়ি কর্‌তে চাইনে, বড়দা’, যদি অসুবিধে না হয়, একবার দেখে শুনে আস্‌বেন।”

বেণী চুপ করিয়া রহিল। গোবিন্দ কি একটা বলিবার চেষ্টা করিতেই রমেশ উঠিয়া চলিয়া গেল। তখন গোবিন্দ বাহিরের দিকে গলা বাড়াইয়া দেখিয়া ফিস্‌-ফিস্ করিয়া বলিল, “দেখ্‌লে, বেণীবাবু, কথার ভাবখানা!” বেণী অন্যমনস্ক হইয়া কি ভাবিতেছিল, কথা কহিল না।

পথে চলিতে চলিতে গোবিন্দের কথাগুলা মনে করিয়া রমেশের সমস্ত মন ঘৃণায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। সে অর্দ্ধেক পথ হইতে ফিরিয়া আসিয়া সেই রাত্রেই আবার বেণী ঘোষালের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। চণ্ডীমণ্ডপের মধ্যে তখন তর্ক-কোলাহল উদ্দাম হইয়া উঠিয়াছিল; কিন্তু সে শুনিতেও তাহার প্রবৃত্তি হইল না। সোজা ভিতরে প্রবেশ করিয়া রমেশ ডাকিল, “জ্যাঠাইমা!”

জ্যাঠাইমা তাঁহার ঘরের সুমুখের বারান্দায় অন্ধকারে চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন; এত রাত্রে রমেশের গলা শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন। “রমেশ? কেন রে?” রমেশ উঠিয়া আসিল। জ্যাঠাইমা ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “একটু দাঁড়া, বাবা, একটা আলো আন্‌তে ব’লে দি।” “আলোয় কাজ নেই জ্যাঠাইমা, তুমি উঠো না।” বলিয়া রমেশ অন্ধকারেই একপাশে বসিয়া পড়িল। তখন জ্যাঠাইমা প্রশ্ন করিলেন, “এত রাত্তিরে যে?”

রমেশ মৃদু কন্ঠে কহিল, “এখনো ত নিমন্ত্রণ করা হয়নি, জ্যাঠাইমা, তাই তোমাকে জিজ্ঞেস কর্‌তে এলুম।” “তবেই মুস্কিলে ফেল্‌লি বাবা! এঁরা কি বলেন? গোবিন্দ গাঙ্গুলী, চাটুয্যে মশাই—” রমেশ বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, “জানিনে, জ্যাঠাইমা, কি এঁরা বলেন। জান্‌তেও চাইনে—তুমি যা’ বল্‌বে তাই হবে।” অকস্মাৎ রমেশের কথার উত্তাপে বিশ্বেশ্বরী মনে মনে বিস্মিত হইয়া ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিলেন, “কিন্তু তখন যে বল্‌লি রমেশ, এরাই তোর সব চেয়ে আপনার! তা’ যাই হোক, আমার মেয়েমানুষের কথায় কি হবে বাবা? —এ গাঁয়ে যে আবার,—আর এ গাঁয়েই কেন বলি, সব গাঁয়েই—এ ওর সঙ্গে খায় না, ও তার সঙ্গে কথা কয় না—একটা কাজকর্ম্ম পড়ে গেলে আর মানুষের দুর্ভাবনার অন্ত থাকে না। কাকে বাদ দিয়ে কাকে রাখা যায়, এর চেয়ে শক্ত কাজ আর গ্রামের মধ্যে নেই।” রমেশ বিশেষ আশ্চর্য্য হইল না। কারণ, এই কয়দিনের মধ্যেই সে অনেক জ্ঞানলাভ করিয়াছিল। তথাপি জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, এ রকম হয়, জ্যাঠাইমা?” “সে অনেক কথা, বাবা। যদি থাকিস্‌ এখানে, আপনিই সব জান্‌তে পারবি। কারুর সত্যিকার দোষ-অপরাধ আছে, কারুর মিথ্যে অপবাদ আছে—তা’ ছাড়া মামলা—মকদ্দমা, মিথ্যে সাক্ষী দেওয়া নিয়েও মস্ত দলাদলি। আমি যদি তোর ওখানে দুদিন আগে যেতুম, রমেশ, তা হ’লে এত উদ্যোগ আয়োজন কিছুতে ক’রতে দিতুম না। কি যে সেদিন হবে, তাই কেবল আমি ভাবচি।” বলিয়া জ্যাঠাইমা একটা নিশ্বাস ফেলিলেন। সে নিশ্বাসে যে কি ছিল, তাহার ঠিক মর্ম্মটি রমেশ ধরিতে পারিল না, এবং কাহারো সত্যকার অপরাধই বা কি এবং কাহারও মিথ্যা অপবাদই বা কি হইতে পারে, তাহাও ঠাহর করিতে পারিল না। বরঞ্চ উত্তেজিত হইয়া কহিল,—“কিন্তু আমার সঙ্গে ত তার কোন যোগ নেই। আমি একরকম বিদেশী বল্‌লেই হয়—কারো সঙ্গে কোন শত্রুতা নেই। তাই আমি বলি জ্যাঠাইমা, আমি দলাদলির কোন বিচারই কর্‌ব না, সমস্ত ব্রাহ্মণ-শূদ্রই নিমন্ত্রণ করে আস্‌ব। কিন্তু, তোমার হুকুম ছাড়া ত পারিনে; তুমি হুকুম দাও জ্যাঠাইমা!” জ্যাঠাইমা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া ভাবিয়া বলিলেন—“এ রকম হুকুম ত দিতে পারিনে রমেশ! তাতে ভারি গোলযোগ ঘটবে। তবে তোর কথাও যে সত্যি নয়, তাও আমি বলিনে। কিন্তু এ ঠিক সত্যি-মিথ্যের কথা নয়, বাবা। সমাজ যাকে শাস্তি দিয়ে আলাদা ক’রে রেখেচে, তাকে জবরদস্তি ক’রে ডেকে আনা যায় না। সমাজ যাই হোক্‌, তাকে মান্য করতেই হবে। নইলে তার ভাল কর্‌বার মন্দ কর্‌বার কোন শক্তিই থাকে না—এ রকম হ’লে ত কোনমতে চল্‌তে পারে না রমেশ!” ভাবিয়া দেখিলে রমেশ এ কথা যে অস্বীকার করিতে পারিত, তাহা নহে; কিন্তু এইমাত্র নাকি বাহিরে এই সমাজের শীর্ষস্থানীয়দের ষড়্‌যন্ত্র এবং নীচাশয়তা তাহার বুকের মধ্যে আগুনের শিখার মত জ্বলিতেছিল, তাই, সে তৎক্ষণাৎ ঘৃণাভরে বলিয়া উঠিল, “এ গাঁয়ের সমাজ বল্‌তে ধর্ম্মদাস, গোবিন্দ—এঁরা ত? এমন সমাজের একবিন্দু ক্ষমতাও না থাকে, সেই ত ঢের ভাল, জ্যাঠাইমা!” জ্যাঠাইমা রমেশের উষ্ণতা লক্ষ্য করিলেন; কিন্তু শান্তকণ্ঠে বলিলেন, “শুধু এঁরা নয়, রমেশ, তোমার বড়দা’ বেণীও সমাজের একজন কর্ত্তা।” রমেশ চুপ করিয়া রহিল। তিনি পুনরপি বলিলেন, “তাই আমি বলি, এঁদের মত নিয়ে কাজ করো গে, রমেশ! সবেমাত্র বাড়ীতে পা দিয়েই এঁদের বিরুদ্ধতা করা ভাল নয়।” বিশ্বেশ্বরী কতটা দূর চিন্তা করিয়া যে এইরূপ উপদেশ দিলেন, তীব্র উত্তেজনার মুখে রমেশ তাহা ভাবিয়া দেখিল না; কহিল, “তুমি নিজে এইমাত্র বল্‌লে জ্যাঠাইমা, নানান্‌ কারণে এখানে দলাদলির সৃষ্টি হয়। বোধ করি, ব্যক্তিগত আক্রোশটাই সবচেয়ে বেশী। তা’ ছাড়া, আমি যখন সত্যিমিথ্যে কারো কোন দোষ অপরাধের কথাই জানিনে, তখন, কোন লোককেই বাদ দিয়ে অপমান করা আমার পক্ষে অন্যায়।” জ্যাঠাইমা একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, “ওরে পাগ্‌লা, আমি যে তোর গুরুজন—মায়ের মত। আমার কথাটা না শোনাও ত তোর পক্ষে অন্যায়!” “কি কর্‌ব জ্যাঠাইমা, আমি স্থির করিচি, আমি সকলকেই নিমন্ত্রণ কর্‌ব।” তাহার দৃঢ়সঙ্কল্প দেখিয়া বিশ্বেশ্বরীর মুখ অপ্রসন্ন হইল; বোধ করি বা মনে মনে বিরক্ত হইলেন; বলিলেন, “তা হ’লে আমার হুকুম নিতে আসাটা তোমার শুধু একটা ছল মাত্র।” জ্যাঠাইমার বিরক্তি রমেশ লক্ষ্য করিল, কিন্তু বিচলিত হইল না। খানিক পরে আস্তে আস্তে বলিল, “আমি জান্‌তুম জ্যাঠাইমা, যা অন্যায় নয়, আমার সে কাজে তুমি প্রসন্নমনে আমাকে আশীর্ব্বাদ করবে। আমার—” তাহার কথাটা শেষ হইবার পূর্ব্বেই বিশ্বেশ্বরী বাধা দিয়া বলিয়া উঠিলেন, কিন্তু এটাও ত তোমার জানা উচিত ছিল, রমেশ, যে, আমার সন্তানের বিরুদ্ধে আমি যেতে পার্‌ব না?”

কথাটা রমেশকে আঘাত করিল। কারণ, মুখে সে যাই বলুক, কেমন করিয়া তাহার সমস্ত অন্তঃকরণ কা’ল হইতে এই জ্যাঠাইমার কাছে সন্তানের দাবী করিতেছিল, এখন দেখিল, এ দাবীর অনেক ঊর্দ্ধে তাঁর আপন সন্তানের দাবী জায়গা জুড়িয়া বসিয়া আছে। সে ক্ষণকালমাত্র চুপ করিয়া থাকিয়াই উঠিয়া দাঁড়াইয়া চাপা অভিমানের সুরে বলিল,—“কা’ল পর্য্যন্ত তাই জান্‌তুম, জ্যাঠাইমা! তাই তোমাকে তখন বলেছিলুম, যা’ পারি, আমি একলা করি, তুমি এসো না, তোমাকে ডাকবার সাহসও আমার হয়নি।” এই ক্ষুণ্ণ অভিমান জ্যাঠাইমার অগোচর রহিল না। কিন্তু আর জবাব দিলেন না, অন্ধকারে চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। খানিকপরে রমেশ চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেই বলিলেন, “তবে একটু দাঁড়াও বাছা, তোমার ভাঁড়ার ঘরের চাবিটা এনে দিই” বলিয়া ঘরের ভিতর হইতে চাবি আনিয়া রমেশের পায়ের কাছে ফেলিয়া দিলেন। রমেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া অবশেষে গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া চাবিটা তুলিয়া লইয়া আস্তে আস্তে চলিয়া গেল। ঘণ্টাকয়েকমাত্র পূর্ব্বে সে মনে মনে বলিয়াছিল, ‘আর আমার ভয় কি, আমার জ্যাঠাইমা আছেন।’ কিন্তু একটা রাত্রিও কাটিল না, তাহাকে আবার নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিতে হইল, “না, আমার কেউ নেই—জ্যাঠাইমাও আমাকে ত্যাগ করিয়াছেন।”

বাহিরে এইমাত্র শ্রাদ্ধ শেষ হইয়া গেছে। আসন হইতে উঠিয়া রমেশ অভ্যাগতদিগের সহিত পরিচিত হইবার চেষ্টা করিতেছে—বাড়ীর ভিতরে আহারের জন্য পাতা পাড়িবার আয়োজন হইতেছে, এমন সময় একটা গোলমাল হাঁকাহাঁকি শুনিয়া রমেশ ব্যস্ত হইয়া, ভিতরে আসিয়া উপস্থিত হইল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই আসিল। ভিতরে রন্ধনশালার কপাটের একপাশে একটি ২৫।২৬ বছরের বিধবা মেয়ে জড়সড় হইয়া, পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে এবং আর একটি প্রৌঢ়া রমণী তাহাকে আগলাইয়া দাঁড়াইয়া ক্রোধে চোখমুখ রক্তবর্ণ করিয়া চীৎকারে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাহির করিতেছে। বিবাদ বাধিয়াছে পরাণ হালদারের সহিত। রমেশকে দেখিবামাত্র প্রৌঢ়া চেঁচাইয়া প্রশ্ন করিল, “হাঁ বাবা, তুমিও ত গাঁয়ের একজন জমিদার, বলি, যত দোষ কি এই ক্ষেন্তি বাম্‌নির মেয়ের? মাথার ওপর আমাদের কেউ নেই ব’লে কি যতবার খুসি শাস্তি দেবে?” গোবিন্দকে দেখাইয়া কহিল, “ঐ উনি মুখুয্যে বাড়ীর গাছ-পিতিষ্ঠের সময় জরিমানা ব’লে ইস্কুলের নামে দশটাকা আমার কাছে আদায় করেননি কি? গাঁয়ের ষোলো–আনা শেতলা-পুজোর জন্যে দুজোড়া পাঁঠার দাম ধ’রে নেননি কি? তবে, কতবার ঐ এক কথা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কর্‌তে চান, শুনি?” রমেশ ব্যাপারটা কি, কিছুই বুঝিতে পারিল না। গোবিন্দ গাঙুলী বসিয়াছিল, মীমাংসা করিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। একবার রমেশের দিকে, একবার প্রৌঢ়ার দিকে চাহিয়া গম্ভীর গলায় কহিল, “যদি আমার নাম্‌টাই কর্‌লে, ক্ষান্তমাসী, তবে সত্যি কথা বলি, বাছা! খাতিরে কথা কইবার লোক এই গোবিন্দ গাঙুলী নয়। সে দেশ শুদ্ধ লোক জানে। তোমার মেয়ের প্রাশ্চিত্যও হয়েচে, সামাজিক জরিমানাও আমরা করেছি—সব মানি। কিন্তু তাকে যজ্ঞিতে কাঠি দিতে ত আমরা হুকুম দিইনি! মর্‌লে ওকে পোড়াতে আমরা কাঁধ দেব, কিন্তু—” ক্ষান্তমাসী চীৎকার করিয়া উঠিল, “ম’লে তোমার নিজের মেয়েকে কাঁধে ক’রে পুড়িয়ে এসো বাছা—আমার মেয়ের ভাবনা তোমাকে ভাব্‌তে হবে না। বলি, হাঁ গোবিন্দ, নিজের গায়ে হাত দিয়ে কি কথা কও না? তোমার ছোট–ভাজ যে ঐ ভাঁড়ার ঘরে বসে পান সাজ্‌চে, সে আর বছর মাসদেড়েক ধ’রে কোন্‌ কাশীবাস ক’রে অমন হল্‌দে রোগা শল্‌তেটির মত হয়ে ফিরে এসেছিল, শুনি? সে বড়লোকের বড় কথা বুঝি? বেশী ঘেঁটিয়ো না, বাপু, আমি সব জারিজুরি ভেঙে দিতে পারি। আমরাও ছেলেমেয়ে পেটে ধরেচি, আমরা চিন্‌তে পারি। আমাদের চোখে ধূলো দেওয়া যায় না।” গোবিন্দ ক্ষ্যাপার মত ঝাঁপাইয়া পড়িল—“তবে রে, হারামজাদা মাগী—” কিন্তু হারামজাদা মাগী একটুও ভয় পাইল না, বরং এক পা আগাইয়া আসিয়া হাতমুখ ঘুরাইয়া কহিল, “মারবি না কি রে? ক্ষেন্তিবাম্‌নিকে ঘাঁটালে ঠগ্‌ বাছতে গাঁ উজোড় হয়ে যাবে, তা’ বলে দিচ্চি। আমার মেয়ে ত রান্নাঘরে ঢুকতে যায়নি; দোর-গোড়ায় আস্‌তে না আস্‌তে হালদার ঠাকুরপো যে খামকা অপমান ক’রে বস্‌ল, বলি তার বেয়ানের তাঁতি-অপবাদ ছিল নাকি? আমি ত আর আজকের নই গো, বলি, আরও বল্‌ব, না এতেই হবে?” রমেশ কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ভৈরব আচার্য্য ব্যস্ত হইয়া ক্ষান্তর হাতটা প্রায় ধরিয়া ফেলিয়া সানুনয়ে কহিল, “এতেই হবে, মাসি, আর কাজ নেই। নে, সুকুমারী, ওঠ মা, চল্‌ বাছা, আমার সঙ্গে ওঘরে গিয়ে বস্‌বি চল্‌।” পরাণ হালদার চাদর কাঁধে লইয়া সোজা খাড়া হইয়া উঠিয়া বলিল, “এই বেশ্যে মাগীদের বাড়ী থেকে একেবারে তাড়িয়ে না দিলে এখানে আমি জলগ্রহণ কর্‌ব না, তা’ বলে দিচ্চি। গোবিন্দ! কালীচরণ! তোমাদের মামাকে চাও, ত উঠে এসো বল্‌চি। বেণী ঘোষাল যে তখন বলেছিল, “মামা, যেয়ো না ওখানে!’ এমন সব খান্‌কী-নটীর কাণ্ডকারখানা জান্‌লে কি জাত-জন্ম খোয়াতে এ বাড়ীর চৌকাঠ মাড়াই? কালী! উঠে এসো।” মাতুলের পুনঃ পুনঃ আহ্বানেও কিন্তু কালীচরণ ঘাড় হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল। সে পাটের ব্যবসা করে। বছরচারেক পূর্ব্বে কলিকাতাবাসী তাহার এক গণ্যমান্য খরিদ্দার বন্ধু তাহার বিধবা ছোটভগিনীটিকে লইয়া প্রস্থান করিয়াছিল। ঘটনাটি গোপন ছিল না। হঠাৎ শ্বশুরবাটী যাওয়া এবং তথা হইতে তীর্থযাত্রা ইত্যাদি প্রসঙ্গে কিছুদিন চাপা ছিল মাত্র। পাছে সেই দুর্ঘটনার ইতিহাস এত লোকের সমক্ষে আবার উঠিয়া পড়ে, এই ভয়ে কালী মুখ তুলিতে পারিল না। কিন্তু গোবিন্দের গায়ের জ্বালা আদৌ কমে নাই। সে আবার উঠিয়া দাঁড়াইয়া জোর গলায় কহিল, “যে যাই বলুক না কেন, এ অঞ্চলে সমাজপতি হলেন বেণী ঘোষাল, পরাণ হালদার আর যদু মুখুজ্যে মহাশয়ের কন্যা। তাঁদের আমরা ত কেউ ফেলতে পার্‌ব না! রমেশ বাবাজী সমাজের অমতে এই দুটো মাগীকে কেন বাড়ী ঢুক্‌তে দিয়েচেন, তার জবাব না দিলে, আমরা এখানে জলটুকু পর্য্যন্ত মুখে দিতে পারব না।” দেখিতে দেখিতে পাঁচসাত-দশজন চাদর কাঁধে ফেলিয়া একে একে উঠিয়া দাঁড়াইল। ইহারা পাড়াগাঁয়েরই লোক, সামাজিক ব্যাপারে কোথায় কোন চাল্‌ সর্ব্বাপেক্ষা লাভজনক, ইহা তাহাদের অবিদিত নহে।

নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ-সজ্জনেরা যাহারা যা খুসি বলিতে লাগিল। ভৈরব এবং দীনু ভট্‌চায কাঁদ কাঁদ হইয়া বার বার ক্ষান্তমাসী ও তাহার মেয়ের, একবার গাঙুলী ও হালদার মহাশয়ের হাতে-পায়ে ধরিবার উপক্রম করিতে লাগিল—চারিদিক্‌ হইতে সমস্ত অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকর্ম্ম যেন লণ্ডভণ্ড হইবার সূচনা প্রকাশ করিল। কিন্তু রমেশ একটি কথা কহিতে পারিল না; একে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় নিতান্ত কাতর, তাহাতে অকস্মাৎ এই অভাবনীয় কাণ্ড। সে পাংশুমুখে কেমন যেন একরকম হতবুদ্ধির মত স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল।

“রমেশ!” অকস্মাৎ এক মুহূর্ত্তে সমস্ত লোকের সচকিত দৃষ্টি এক হইয়া বিশ্বেশ্বরীর মুখের উপর গিয়া পড়িল। তিনি ভাঁড়ার হইতে বাহির হইয়া কপাটের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। তাঁহার মাথার উপর আঁচল ছিল কিন্তু মুখখানি অনাবৃত। রমেশ দেখিল, জ্যাঠাইমা আপনিই কখন্‌ আসিয়াছেন—তাহাকে ত্যাগ করেন নাই। বাহিরের লোক দেখিল, ইনিই বিশ্বেশ্বরী, ইনিই ঘোষাল বাড়ীর গিন্নী-মা!

পল্লীগ্রামে সহরের কড়াপর্দ্দা নাই। তত্রাচ বিশ্বেশ্বরী বড়বাড়ীর বধূ বলিয়াই হৌক্‌, কিংবা অন্য যে-কোন কারণেই হৌক, যথেষ্ট বয়ঃপ্রাপ্তিসত্ত্বেও সাধারণতঃ কাহারো সাক্ষাতে বাহির হইতেন না। সুতরাং, সকলেই বড় বিস্মিত হইল। যাহারা শুধু শুনিয়াছিল, কিন্তু ইতিপূর্ব্বে কখনো চোখে দেখে নাই, তাহারা তাঁহার আশ্চর্য্য চোখ দুইটির পানে চাহিয়া একেবারে অবাক্‌ হইয়া গেল। বোধ করি, তিনি হঠাৎ ক্রোধবশেই বাহির হইয়া পড়িয়াছিলেন। সকলে মুখ তুলিবামাত্রই তিনি তৎক্ষণাৎ থামের পার্শ্বে সরিয়া গেলেন। সুস্পষ্ট, তীব্র আহ্বানে রমেশের বিহ্বলতা ঘুচিয়া গেল। সে সম্মুখে অগ্রসর হইয়া আসিল। জ্যাঠাইমা আড়াল হইতে তেম্‌নি সুস্পষ্ট, উচ্চকণ্ঠে বলিলেন, “গাঙুলী মশায়কে ভয় দেখাতে মানা ক’রে দে, রমেশ! আর হালদার মশায়কে আমার নাম ক’রে বল্‌ যে, আমি সবাইকে আদর ক’রে বাড়ীতে ডেকে এনেচি—সুকুমারীকে অপমান কর্‌বার তাঁর কোন প্রয়োজন ছিল না। আমার কাজকর্ম্মের বাড়ীতে হাঁকাহাঁকি, চেঁচাচেঁচি, গালিগালাজ কর্‌তে আমি নিষেধ কর্‌চি। যাঁর অসুবিধে হবে, তিনি আর কোথায় গিয়ে বসুন।” বড়গিন্নীর কড়া হুকুম সকলে নিজের কানেই শুনিতে পাইল। রমেশের মুখ ফুটিয়া বলিতে হইল না—হইলে সে পারিত না। ইহার ফল কি হইল, তাহা সে দাঁড়াইয়া দেখিতেও পারিল না। জ্যাঠাইমাকে সমস্ত দায়িত্ব নিজের মাথায় লইতে দেখিয়া, সে কোনমতে চোখের জল চাপিয়া দ্রুতপদে একটা ঘরে গিয়া ঢুকিল; তৎক্ষণাৎ তাহার দুই চোখ ছাপাইয়া দর-দর করিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। আজ সারাদিন সে নিজের কাজে বড় ব্যস্ত ছিল, কে আসিল না আসিল, তাহার খোঁজ লইতে পারে নাই। কিন্তু আর যেই আসুক, জ্যাঠাইমা যে আসিতে পারেন, ইহা তাহার সুদূর কল্পনারও অতীত ছিল। যাহারা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, তাহারা আস্তে আস্তে বসিয়া পড়িল। শুধু গোবিন্দ গাঙুলী ও পরাণ হালদার আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কে একজন তাহাদিগকে উদ্দেশ করিয়া ভিড়ের ভিতর হইতে অস্ফুটে কহিল, “বসে পড় না খুড়ো! ষোলখানা লুচি, চারজোড়া সন্দেশ কে কোথায় খাইয়ে দাইয়ে সঙ্গে দেয়, বাবা!” পরাণ হালদার ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। কিন্তু আশ্চর্য, গোবিন্দ গাঙুলী সত্যই বসিয়া পড়িল। তবে মুখখানা সে বরাবর ভারী করিয়া রাখিল এবং আহারের জন্য পাতা পড়িলে তত্ত্বাবধানের ছুতা করিয়া সকলের সঙ্গে পংক্তিভোজনে উপবেশন করিল না। যাহারা তাহার এই ব্যবহার লক্ষ্য করিল, তাহারা সকলেই মনে মনে বুঝিল, গোবিন্দ সহজে কাহাকেও নিষ্কৃতি দিবে না। অতঃপর আর কোন গোলযোগ ঘটিল না। ব্রাহ্মণেরা যাহা ভোজন করিলেন, তাহা চোখে না দেখিলে প্রত্যয় করা শক্ত; এবং প্রত্যেকেই খুদি, পটল, ন্যাড়া, বুড়ী প্রভৃতি বাটীর অনুপস্থিত বালক–বালিকার নাম করিয়া যাহা বাঁধিয়া লইলেন, তাহাও যৎকিঞ্চিৎ নহে। সন্ধ্যার পর কাজকর্ম্ম প্রায় সারা হইয়া গেছে, রমেশ সদর-দরজার বাহিরে একটা পেয়ারাগাছের তলায় অন্যমনস্কের মত দাঁড়াইয়াছিল, মনটা তাহার ভাল ছিল না। দেখিল দীনু ভট্টাচার্য্য ছেলেদের লইয়া, লুচি-মণ্ডার গুরুভারে ঝুঁকিয়া পড়িয়া, একরূপ অলক্ষ্যে বাহির হইয়া যাইতেছে। সর্ব্বপ্রথমে খেঁদির নজর পড়ায় সে অপরাধীর মত থতমত খাইয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়া শুষ্ককণ্ঠে কহিল,“বাবা, বাবু দাঁড়িয়ে—” সবাই যেন একটু জড়সড় হইয়া পড়িল। ছোট মেয়েটির এই একটি কথা হইতেই রমেশ সমস্ত ইতিহাসটা বুঝিতে পারিল; পলাইবার পথ থাকিলে সে নিজেই পলাইত। কিন্তু সে উপায় ছিল না বলিয়া, আগাইয়া আসিয়া সহাস্যে কহিল, “খেঁদি, এ সব কার জন্যে নিয়ে যাচ্ছিস্‌ রে?” তাহাদের ছোট বড় পুঁটুলিগুলির ঠিক সদুত্তর খেঁদি দিতে পারিবে না আশঙ্কা করিয়া দীনু নিজেই একটুখানি শুষ্কভাবে হাসিয়া বলিলেন, “পাড়ার ছোটলোকদের ছেলেপিলেরা আছে ত বাবা, এঁটোকাঁটাগুলো নিয়ে গেলে তাদের দু’খানা চারখানা দিতে পার্‌ব। সে যাই হোক্‌, বাবা, কেন যে দেশসুদ্ধ লোক ওকে গিন্নী-মা ব’লে ডাকে, তা’ আজ বুঝ্‌লুম।” রমেশ তাহার কোন উত্তর না করিয়া সঙ্গে সঙ্গে ফটকের ধার পর্য্যন্ত আসিয়া হঠাৎ প্রশ্ন করিল, “আচ্ছা ভট্‌চায্যি মশাই, আপনি ত এদিকের সমস্তই জানেন, এ গাঁয়ে এত রেষারেষি কেন বল্‌তে পারেন?” দীনু মুখে একটা আওয়াজ করিয়া বার দুই ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “হায় রে বাবাজী, আমাদের কুঁয়াপুর ত পদে আছে। যে কাণ্ড এ ক’দিন ধরে খেঁদির মামার বাড়ীতে দেখে এলুম! বিশঘর বামুন-কায়েতের বাস নেই, গাঁয়ের মধ্যে কিন্ত চারটে দল! হরনাথ বিশ্বেস, দুটো বিলিতি আমড়া পেড়েছিল বলে তার আপনার ভাগ্নেকে জেলে দিয়ে তবে ছাড়লে। সমস্ত গ্রামই, বাবা, এই রকম—তা’ ছাড়া মাম্‌লায় মাম্‌লায় একেবারে শতচ্ছিদ্র! খেঁদি, হরিধনের হাতটা একবার বদলে নে, মা।” রমেশ আবার জিজ্ঞাসা করিল, “এর কি কোন প্রতীকার নেই’ ভট্‌চায্যিমশাই?” “প্রতীকার আর কি ক’রে হবে, বাবা—এ যে ঘোর কলি!” ভট্টাচার্য্য একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “তবে একটা কথা ব’ল্‌তে পারি বাবাজী। আমি ভিক্ষেসিক্ষে ক’র্‌তে অনেক জায়গাতেই ত যাই—অনেকে অনুগ্রহও করেন। আমি বেশ দেখেচি, তোমাদের ছেলেছোকরাদের দয়াধর্ম্ম আছে—নেই কেবল বুড়ো ব্যাটাদের। এরা একটু বাগে পেলে আর একজনের গলায় পা দিয়ে জিভ বার না ক’রে আর ছেড়ে দেয় না।” বলিয়া দীনু যেমন ভঙ্গী করিয়া জিভ বাহির করিয়া দেখাইল, তাহাতে রমেশ হাসিয়া ফেলিল। দীনু কিন্তু হাসিতে যোগ দিল না—কহিল, “হাসির কথা নয় বাবাজী, অতি সত্য কথা। আমি নিজেও প্রাচীন হয়েচি—কিন্ত—তুমি যে অন্ধকারে অনেকদূর এগিয়ে এলে, বাবাজী।” “তা’ হোক্‌ ভট্‌চায্যিমশাই, আপনি বলুন।” “কি আর বল্‌ব বাবা, পাড়াগাঁ মাত্রই এই রকম। এই গোবিন্দ গাঙুলী—এ ব্যাটার বাপের কথা মুখে আন্‌লে প্রায়শ্চিত্ত কর্‌তে হয়। ক্ষান্তবাম্‌নি ত আর মিথ্যে বলেনি—কিন্তু সবাই ওকে ভয় করে! জাল করতে, মিথ্যেসাক্ষী, মিথ্যে মোকদ্দমা সাজাতে ওর জুড়ি নেই। বেণীবাবু হাতধরা—কাজেই কেউ একটি কথা কইতে সাহস করে না, বরঞ্চ ওই-ই পাঁচজনের জাত-মেরে বেড়াচ্চে!” রমেশ অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত আর কোন প্রশ্ন না করিয়া, চুপ করিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল। রাগে তাহার সর্ব্বাঙ্গ জ্বালা করিতেছিল। দীনু নিজেই বলিতে লাগিল—“এই আমার কথা তুমি দেখে নিয়ো বাবা, ক্ষেন্তিবাম্‌নি সহজে নিস্তার পাবে না। গোবিন্দ গাঙুলী, পরাণ হালদার দু-দুটো ভীমরুলের চাকে খোঁচা দেওয়া কি সহজ কথা! কিন্তু যাই বল বাবা, মাগীর সাহস আছে। আর সাহস থাক্‌বে নাই বা কেন? মুড়ী বেচে খায়, সব ঘরে যাতায়াত করে, সকলের সব কথা টের পায়। ওকে ঘাঁটালে কেলেঙ্কারির সীমা-পরিসীমা থাক্‌বে না, তা ব’লে দিচ্চি। অনাচার আর কোন্ ঘরে নেই বল? বেণীবাবুকেও—” রমেশ সভয়ে বাধা দিয়া বলিল, “থাক্‌, বড়দার কথার আর কাজ নেই”—দীনু অপ্রতিভ হইয়া উঠিল। কহিল, “থাক্‌, বাবা, আমি দুঃখী মানুষ, কারো কথায় আমার কাজ নেই। কেউ যদি বেণীবাবুর কানে তুলে দেয় ত আমার ঘরে আগুন”- রমেশ আবার বাধা দিয়া কহিল, “ভট্‌চায্যি মশায়, আপনার বাড়ী কি আরো দূরে?”

“না, বাবা, বেশী দূর নয়, এই বাঁধের পাশেই আমার কুঁড়ে—কোন দিন যদি—” “আস্‌ব বই কি, নিশ্চয় আসব”- বলিয়া রমেশ ফিরিতে উদ্যত হইয়া কহিল, “আবার কাল সকালেই ত দেখা হবে—কিন্তু তাঁর পরেও মাঝে মাঝে পায়ের ধুলো দেবেন।” বলিয়া রমেশ ফিরিয়া গেল। “দীর্ঘজীবী হও—বাপের মত হও!” বলিয়া দীনু ভট্‌চায অন্তরের ভিতর হইতে আশীর্ব্বচন বাহির করিয়া ছেলেপুলে লইয়া চলিয়া গেল।

এ পাড়ায় একমাত্র মধু পালের মুদির দোকান নদীর পথে হাটের একধারে। দশ বার দিন হইয়া গেল, অথচ সে বাকী দশ টাকা লইয়া যায় নাই বলিয়া, রমেশ কি মনে করিয়া নিজেই একদিন সকালবেলা দোকানের উদ্দেশে বাহির হইয়া পড়িল। মধু পাল মহাসমাদর করিয়া ছোটবাবুকে বারান্দার উপর মোড়া পাতিয়া বসাইল এবং ছোট বাবুর আসিবার হেতু শুনিয়া গভীর আশ্চর্য্যে অবাক হইয়া গেল। যে ধারে, সে উপযাচক হইয়া ঘর বহিয়া ঋণশোধ করিতে আসে, তাহা মধু পাল এতটা বয়সে কখন চোখে ত দেখেই নাই, কানেও শোনে নাই। কথায় কথায় অনেক কথা হইল। মধু কহিল, “দোকান কেমন ক’রে চল্‌বে, বাবু? দু’ আনা চার আনা একটাকা পাঁচসিকে ক’রে প্রায় পঞ্চাশ ষাট টাকা বাকী পড়ে গেছে। এই দিয়ে যাচ্চি ব’লে দু মাসেও আদায় হবার যো’ নেই। এ কি-বাঁডুয্যে মশাই যে! কবে এলেন? প্রাতঃ পেন্নাম হই।”

বাঁডুয্যে মশায়ের বা হাতে একটা গাড়ু, পায়ের নখে, গোড়ালিতে কাদার দাগ, কানে পৈতা জড়ানো, ডানহাতে কচুপাতায় মোড়া চারিটি কুচোচিংড়ি। তিনি ফোঁস করিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “কাল রাত্তিরে এলুম; তামাক থা’ দিকি মধু!” বলিয়া গাড়ু রাখিয়া হাতের চিংড়ি মেলিয়া ধরিয়া বলিলেন, “সৈরুবি জেলেনীর আক্কেল দেখলি, মধু—খপ্‌ ক’রে হাতটা আমার ধ’রে ফেল্‌লে? কালেকালে কি হ’ল বল্‌ দেখি রে, এই কি এক পয়সার চিংড়ি? বামুনকে ঠকিয়ে ক’কাল খাবি মাগী, উচ্ছন্ন যেতে হবে না?” মধু বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিল’ “হাত ধরে ফেল্‌লে আপনার?” ক্রুদ্ধ বাঁডুয্যে মশাই একবার চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া উত্তেজিত হইয়া কহিলেন—“আড়াইটি পয়সা শুধু বাকী, তাই ব’লে খামকা হাটশুদ্ধ লোকের সাম্‌নে হাত ধর্‌বে আমার? কে না দেখ্‌লে বল্‌। মাঠ থেকে ব’সে এসে, গাড়ুটি মেজে নদীতে হাত-পা ধুয়ে মনে কর্‌লুম, হাটটা একবার ঘুরে যাই, মাগী এক চুবড়ি মাছ নিয়ে ব’সে,—আমাকে স্বছন্দে বল্‌লে কি না, কিছুই নেই ঠাকুর, যা’ ছিল, সব উঠে গেছে। আরে, আমার চোখে ধুলো দিতে পারিস্‌? ডালাটা ফস্‌ ক’রে তুলে ফেলতেই হাতটা চেপে ধ’রে ফেল্‌লে! তোর এই আড়াইটা—আর আজকার একটা—এই সাড়ে তিনটে পয়সা নিয়ে আমি গাঁ ছেড়ে পালাব? কি বলিস, মধু?” মধু সায় দিয়া কহিল, “তাও কি হয়!” “তবে, তাই বল্‌ না! গাঁয়ে কি শাসন আছে? নইলে ষষ্ঠে জেলের খোপা-নাপ্‌তে বন্ধ ক’রে, চাল কেটে তুলে দেওয়া যায় না!” হঠাৎ রমেশের প্রতি চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, “বাবুটি কে, মধু?” মধু সগর্ব্বে কহিল, “আমাদের ছোটবাবুর ছেলে যে! সেদিনের দশ টাকা বাকী ছিল ব’লে, নিজে বাড়ী বয়ে দিতে এসেচেন।” বাঁডুয্যে মশাই কুচোচিংড়ির অভিযোগ ভুলিয়া, দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিলেন,—“হ্যাঁ, রমেশ বাবাজী? বেঁচে থাক, বাবা—হাঁ, এসে শুনলুম, একটা কাজের মত কাজ করেচ বটে! এমন খাওয়া-দাওয়া এ অঞ্চলে কখনও হয় নি। কিন্তু বড় দুঃখ রইল, চোখে দেখ্‌তে পেলুম না। পাঁচ শালার ধাপ্পায় প’ড়ে কল্‌কাতায় চাকুরি কর্‌তে গিয়ে হাড়ীর হাল। আরে ছি, সেখানে মানুষ থাক্‌তে পারে!” রমেশ এই লোকটার মুখের দিকে চুপ করিয়া চাহিয়া রহিল। কিন্তু দোকান-শুদ্ধ সকলে তাঁহার কলিকাতা প্রবাসের ইতিহাস শুনিবার জন্য মহাকৌতূহলী হইয়া উঠিল। তামাক সাজিয়া মধু-দোকানি বাঁড়ুয্যের হাতে হুঁকাটা তুলিয়া দিয়া, প্রশ্ন করিল, “তার পরে? একটু চাক্‌রি-বাক্‌রি হয়েছিল ত?” “হবে না? এ কি ধান দিয়ে লেখাপড়া শেখা আমার?—হ’লে হবে কি,—সেখানে কে থাক্‌তে পারে বল! যেমন ধুঁয়া—তেমনি কাদা। বাইরে বেরিয়ে গাড়ীঘোড়া চাপা না প’ড়ে যদি ঘরে ফির্‌তে পারিস্‌, ত জান্‌বি, তোর বাপের পুণ্যি!” মধু কখনও কলিকাতায় যায় নাই। মেদিনীপুর সহরটা, একবার সাক্ষ্য দিতে গিয়া, দেখিয়া আসিয়াছিল মাত্র। সে ভারি আশ্চর্য্য হইয়া কহিল, “বলেন কি!” বাঁড়ুয্যে ঈষৎ হাসিয়া কহিল-“তোর রমেশ বাবুকে জিজ্ঞাসা কর না, সত্যি না মিথ্যে। না মধু, খেতে না পাই, বুকে হাত দিয়ে ঘরে প’ড়ে ম’রে থাকব, সে ভাল, কিন্তু বিদেশ যাবার নামটি যেন কেউ আমার কাছে আর না করে। বল্‌লে বিশ্বেস করবিনে, সেখানে শুষ্‌ণি-কলমি শাক, চালতা, আমড়া, খোড়-মোচা পর্য্যন্ত কিনে খেতে হয়! পার্‌বি খেতে? এই একটি মাস না খেয়ে-খেয়ে যেন রোগা ইঁদুরটি হয়ে গেচি! দিবারাত্রি পেট ফুট-ফাট করে, বুকজ্বালা করে, প্রাণ আইঢাই করে, পালিয়ে এসে তবে হাঁফ-ছেড়ে বাঁচি। না বাবা, নিজের গাঁয়ে ব’সে জোটে একবেলা, একসন্ধ্যে খাবো; না জোটে, ছেলেমেয়ের হাত ধ’রে ভিক্ষে করব; বামুনের ছেলের তাতে কিছু আর লজ্জার কথা নেই, কিন্তু, মা লক্ষী মাথায় থাকুন—বিদেশ কেউ যেন না যায়!” তাঁহার কাহিনী শুনিয়া সকলে যখন সভয়ে নির্ব্বাক হইয়া গেছে, তখন বাঁড়ুয্যে উঠিয়া আসিয়া মধুর তেলের ভাঁড়ের ভিতর উখড়ি ডুবাইয়া একছটাকে তেল বাঁ হাতের তেলোয় লইয়া অর্দ্ধেকটা দুই নাক ও দুই কানের গর্ত্তে ঢালিয়া দিয়া, বাকীটা মাথায় মাখিয়া ফেলিলেন ও কহিলেন, “বেলা হয়ে গেল, অম্‌নি ডুবটা দিয়ে একেবারে ঘরে যাই! এক পরসার নুন দে দেখি, মধু, পয়সাটা বিকেলবেলা দিয়ে যাবো।” “আবার বিকেলবেলা!”বলিয়া মধু অপ্রসন্নমুখে নুণ দিতে তাঁহার দোকানে উঠিল। বাঁড়ুয্যে গলা বাড়াইয়া দেখিয়া, বিস্ময়-বিরক্তির স্বরে কহিয়া উঠিল, “তোরা সব হলি কি, মধু? এ যে গালে চড় মেরে পয়সা নিস্‌, দেখি?” বলিয়া আগাইয়া আসিয়া নিজেই এক খামচা নুন তুলিয়া ঠোঙায় দিয়া সেটা টানিয়া লইলেন। গাড়ু হাতে করিয়া রমেশের প্রতি চাহিয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন,—“ঐ ত একই পথ—চল না বাবাজী, গল্প ক’রতে ক’রতে যাই।” “চলুন”—বলিয়া রমেশ উঠিয়া দাঁড়াইল। মধু-দোকানি অনতিদূরে দাঁড়াইয়া করুণ-কন্ঠে কহিল, “বাড়ুয্যে মশাই, সেই ময়দার পয়সা পাঁচ আনা কি অমনি—”

বাঁড়ুয্যে রাগিয়া উঠিল—“হাঁ রে, মধু, দুবেলা চোখো-চোখি হবে-তোদের কি চোখের চামড়া পর্য্যন্ত নেই? পাঁচ ব্যাটাবেটীর মতলবে কল্‌কাতায় যাওয়া আসা ক’রতে পাঁচপাঁচটা টাকা আমার জলে গেল—আর এই তোদের তাগাদা করবার সময় হ’ল! কারো সর্ব্বনাশ, কারো পোষ মাস—দেখ্‌লে বাবা রমেশ, এদের ব্যাভারটা একবার দেখ্‌লে?” মধু এতটুকু হইয়া গিয়া অস্ফুট বলিতে গেল, “অনেক দিনের—” “হলই বা অনেক দিনের? এমন ক’রে সবাই মিলে পিছনে লাগ্‌লে ত আর গাঁয়ে বাস করা যায় না।” বলিয়া বাঁড়ুয্যে একরকম রাগ করিয়াই নিজের জিনিসপত্র লইয়া চলিয়া গেলেন।

রমেশ ফিরিয়া আসিয়া বাড়ী ঢুকিতেই এক ভদ্রলোক শশব্যস্তে হাতের হুঁকাটা একপাশে রাখিয়া দিয়া, একবারে পায়ের কাছে আসিয়া তাহাকে প্রণাম করিল। উঠিয়া কহিল, “আমি বনমালী পাড়ুই—আপনাদের ইস্কুলের হেডমাষ্টার। দুদিন এসে সাক্ষাৎ পাইনি; তাই বলি—” রমেশ সমাদর করিয়া পাড়ুইমহাশয়কে চেয়ারে বসাইতে গেল; কিন্তু সে সসম্ভ্রমে দাঁড়াইয়া রহিল। কহিল, “আজ্ঞে, আমি যে আপনার ভৃত্য।” লোকটা বয়সে প্রাচীন এবং আর-যেই-হোক একটা বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাহার এই অতি বিনীত কুণ্ঠিত ব্যবহারে রমেশের মনের মধ্যে একটা অশ্রদ্ধার ভাব জাগিয়া উঠিল। সে কিছুতেই আসন-গ্রহণে স্বীকৃত হইল না, খাড়া দাঁড়াইয়া নিজের বক্তব্য কহিতে লাগিল। এদিকের মধ্যে এই একটা অতি ছোট রকমের ইস্কুল, মুখুয্যে ও ঘোষালদের যত্নে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। প্রায় ৩০।৪০ জন ছাত্র পড়ে। দুই তিন ক্রোশ দূর হইতেও কেহ কেহ আসে। যৎকিঞ্চিৎ গভর্ণমেন্ট-সাহায্যও আছে। তথাপি ইস্কুল আর চলিতে চাহিতেছে না। ছেলেবয়সে এই বিদ্যালয়ে রমেশও কিছুদিন পড়িয়াছিল, তাহার স্মরণ হইল। পাড়ুই মহাশয় জানাইল যে, চাল ছাওয়া না হইলে আগামী বর্ষায় বিদ্যালয়ের ভিতর আর কেহ বসিতে পারিবে না। কিন্তু সে না হয় পরে চিন্তা করিলে চলিবে, উপস্থিত প্রধান দুর্ভাবনা হইতেছে যে, তিনমাস হইতে শিক্ষকেরা কেহ মাহিনা পায় নাই—সুতরাং, ঘরের খাইয়া বন্যমহিষ তাড়াইয়া বেড়াইতে আর কেহ পারিতেছে না।

ইস্কুলের কথায় রমেশ একেবারে সজাগ হইয়া উঠিল। হেডমাষ্টার মহাশয়কে বৈঠকখানায় লইয়া গিয়া একটি একটি করিয়া সমস্ত সংবাদ গ্রহণ করিতে লাগিল। মাষ্টারপণ্ডিত চারিজন; এবং তাঁহাদের হাড় ভাঙা খাটুনির ফলে গড়ে দুই জন করিয়া ছাত্র প্রতিবৎসর মাইনার পরীক্ষায় পাস করিয়াছে। তাহাদের নাম-ধাম বিবরণ পাড়ুই মহাশয় মুখস্থর মত আবৃত্তি করিয়া দিল। ছেলেদের নিকট হইতে যাহা আদায় হয়, তাহাতে নীচের দুজন শিক্ষকের কোন মতে, ও গভর্ণমেন্টের সাহায্যে আর একজনের সঙ্কুলান হয়; শুধু একজনের মাহিনাটাই গ্রামের ভিতরে এবং বাহিরে চাঁদা তুলিয়া সংগ্রহ করিতে হয়। এই চাঁদা সাধিবার ভারও মাষ্টারদের উপরেই—তাঁহারা গত তিন চারি মাস কাল ক্রমাগত ঘুরিয়া ঘুরিয়া প্রত্যেক বাটীতে আট-দশবার করিয়া হাঁটা-হাঁটি করিয়াও সাতটাকা চারি আনার বেশী আদায় করিতে পারেন নাই!

কথা শুনিয়া রমেশ স্তম্ভিত হইয়া রহিল। পাঁচছয়টা গ্রামের মধ্যে এই একটা বিদ্যালয়—এবং এই পাঁচছয়টা গ্রামময় তিনমাসকাল ক্রমাগত ঘুরিয়া মাত্র ৭।০ আদায় হইয়াছে! রমেশ প্রশ্ন করিল, “আপনার মাহিনা কত?” মাষ্টার কহিল, “রসিদ দিতে হয় ছাব্বিশ টাকার, পাই তের টাকা পোনর আনা।” কথাটা রমেশ ঠিক বুঝিতে পারিল না—তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিল। মাষ্টার তাহা বুঝাইয়া বলিল, “আজ্ঞে গভর্ণমেন্টের হুকুম কি না, তাই ছাব্বিশ টাকার রসিদ লিখে দিয়ে সবইন্‌স্পেক্টার বাবুকে দেখাতে হয়—নইলে—সরকারী সাহায্য বন্ধ হ’য়ে যায়। সবাই জানে, আপনি কোন ছাত্রকে জিজ্ঞাসা কর্‌লেই জানতে পার্‌বেন—আমি মিথ্যে বল্‌চিনে।” রমেশ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এতে ছাত্রদের কাছে আপনার সম্মানহানি হয় না?” মাষ্টার লজ্জিত হইল। কহিল, কি কর্‌ব, রমেশবাবু! বেণীবাবু এ কয়টি টাকাও দিতে নারাজ।”

“তিনিই কর্ত্তা বুঝি?”

মাষ্টার একবার একটুখানি দ্বিধা করিল; কিন্তু তাহার না বলিলেই নয়। তাই সে ধীরে ধীরে জানাইল যে, “তিনিই সেক্রেটারি বটে; তিনি একটি পয়সাও কখনো খরচ করেন না। যদু মুখুয্যে মহাশয়ের কন্যা—সতীলক্ষ্মী তিনি—তাঁর দয়া না থাকিলে ইস্কুল অনেকদিন উঠিয়া যাইত। এ বৎসর নিজের খরচে চাল ছাইয়া দিবেন, আশা দিয়াও হঠাৎ কেন যে সমস্ত সাহায্য বন্ধ করিয়া দিয়াছেন, তাহার কারণ কেহই বলিতে পারে না।” রমেশ কৌতূহলী হইয়া রমার সম্বন্ধে আরও কয়েকটি প্রশ্ন করিয়া, শেষে জিজ্ঞাসা করিল, “তাঁর একটি ভাই এ ইস্কুলে পড়ে না?” মাষ্টার কহিল, “যতীন ত? পড়ে বৈকি।” রমেশ বলিল, “আপনার ইস্কুলের বেলা হয়ে যাচ্ছে, আজ আপনি যান, কা’ল আমি আপনাদের ওখানে যাব।” “যে আজ্ঞে” বলিয়া হেডমাষ্টার আর একবার রমেশকে প্রণাম করিয়া, জোর করিয়া তাহার পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া, বিদায় হইল।

সেই দিন অপরাহ্নে একটা অচিন্তনীয় ঘটনা ঘটিল। আদালতের বিচার উপেক্ষা করিয়া কৈলাস নাপিত এবং সেখ মতিলাল সাক্ষীসাবুদ সঙ্গে লইয়া রমেশের শরণাপন্ন হইল। রমেশ অকৃত্রিম বিস্ময়ের সহিত প্রশ্ন করিল,—“আমার বিচার তোমরা মান্‌বে কেন বাপু?”

বাদী প্রতিবাদী উভয়েই জবাব দিল,—“মান্‌ব না কেন বাবু, হাকিমের চেয়ে আপনার বিদ্যাবুদ্ধিই কোন্‌ কম? আর, হাকিম হুজুর যা’ কিছু তা’ আপনারা পাঁচজন ভদ্রলোকেই ত হ’য়ে থাকেন! কা’ল যদি আপনি সরকারী চাকরি নিয়ে হাকিম হ’য়ে ব’সে বিচার ক’রে দেন, সেই বিচার ত আমাদেরই মাথা পেতে নিতে হবে! তখন ত মান্‌ব না বল্‌লে চল্‌বে না।” কথা শুনিয়া রমেশের বুক গর্ব্বে, আনন্দে স্ফীত হইয়া উঠিল। কৈলাস কহিল,—“আপনাকে আমরা দুজনেই দুকথা বুঝিয়ে বল্‌তে পারব; কিন্তু, আদালতে সেটি হবে না। তা’ ছাড়া গাঁটের কড়ি মুটোভরে উকিলকে না দিতে পার্‌লে, সুবিধে কিছুতেই হয় না, বাবু! এখানে একটি পয়সা খরচ নেই, উকিলকে খোসামোদ কর্‌তে হবে না, পথ হাঁটাহাঁটি ক’রে মর্‌তে হবে না। না বাবু, আপনি যা’ হুকুম কর্‌বেন, ভাল হোক্‌, মন্দ হোক্‌, আমরা তাতেই রাজী হ’য়ে, আপনার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে, ঘরে ফিরে যাব। ভগবান্‌ সুবুদ্ধি দিলেন, আমরা দুজনে তাই আদালত থেকে ফিরে এসে আপনার চরণেই শরণ নিলাম।” একটা ছোট নালা লইয়া উভয়ের বিবাদ। দলিলপত্র সামান্য যাহা কিছু ছিল, রমেশের হাতে দিয়া কা’ল সকালে আসিবে বলিয়া, উভয়ে লোকজন লইয়া প্রস্থান করিবার পর, রমেশ স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। ইহা তাহার কল্পনার অতীত। সুদূর-ভবিষ্যতেও সে কখনও এত বড় আশা মনে ঠাঁই দেয় নাই। তাহার মীমাংসা ইহারা পরে গ্রহণ করুক বা না করুক, কিন্তু, আজ যে, ইহারা সরকারী আদালতের বাহিরে বিবাদনিষ্পত্তি করিবার অভিপ্রায়ে পথ হইতে ফিরিয়া তাহার কাছে উপস্থিত হইয়াছে, ইহাই তাহার বুক ভরিয়া আনন্দস্রোত ছুটাইয়া দিল। যদিচ, বেশী কিছু নয়, সামান্য দুইজন গ্রামবাসীর অতি তুচ্ছ বিবাদের কথা; কিন্তু, এই তুচ্ছ কথার সূত্র ধরিয়াই তাহার চিত্তের মাঝে অনন্ত সম্ভাবনার আকাশ-কুসুম ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। তাহার এই দুর্ভাগিনী জন্মভূমির জন্য ভবিষ্যতে সে কি যে না করিতে পারিবে, তাহার কোথাও কোনো হিসাব-নিকাশ, কূলকিনারা আর রহিল না। বাহিরে বসন্ত-জ্যোৎস্নায় আকাশ ভাসিয়া যাইতেছিল, সেই দিকে চাহিয়া হঠাৎ তাহার রমাকে মনে পড়িল। অন্য কোন দিন হইলে সঙ্গে সঙ্গেই তাহার সর্ব্বাঙ্গ জ্বালা করিয়া উঠিত। কিন্তু, আজ জ্বালা করা ত দূরের কথা, কোথাও সে একবিন্দু অগ্নিস্ফুলিঙ্গের অস্তিত্বও অনুভব করিল না। মনে মনে একটু হাসিয়া তাহাকে উদ্দেশ করিয়া কহিল,—“তোমার হাত দিয়ে ভগবান্‌ আমাকে এমন সার্থক ক’রে তুলবেন, তোমার বিষ আমার অদৃষ্টে এমন অমৃত হ’য়ে উঠ্‌বে, এ যদি তুমি জান্‌তে রমা, বোধ করি, কখনও আমাকে জেলে দিতে চাইতে না! কে গা?”

“আমি রাধা, ছোটবাবু! রমাদিদি অতি অবিশ্যি করে একবার দেখা দিতে বল্‌চেন।” রমা সাক্ষাৎ করিবার জন্য দাসী পাঠাইয়া দিয়াছে। রমেশ অবাক হইয়া রহিল। আজ এ কোন্‌ নষ্টবুদ্ধি দেবতা তাহার সহিত সকল প্রকারের অনাসৃষ্টি কৌতুক করিতেছেন! দাসী কহিল,—“একবার দয়া ক’রে যদি ছোটবাবু—” “কোথায় তিনি?”

“ঘরে শুয়ে আছেন।” একটু থামিয়া কহিল,—“কাল ত আর সময় হ’য়ে উঠ্‌বে না; তাই এখন যদি একবার—” “আচ্ছা চল যাই—” বলিয়া রমেশ উঠিয়া দাঁড়াইল।

ডাকিতে পাঠাইয়া দিয়া রমা একপ্রকার সচকিত অবস্থায় বিছানায় পড়িয়াছিল। দাসীর নির্দ্দেশমত রমেশ ঘরে ঢুকিয়া, একটা চৌকি টানিয়া লইয়া বসিতেই, সে শুদ্ধমাত্র যেন মনের জোরেই নিজেকে টানিয়া আনিয়া রমেশের পদপ্রান্তে নিক্ষেপ করিল। ঘরের এককোণে মিট্‌ মিট্ করিয়া একটা প্রদীপ জ্বলিতেছিল। তাহারি মৃদু আলোকে রমেশ অস্পষ্ট-আকারে রমার যতটুকু দেখিতে পাইল, তাহাতে তাহার শারীরিক অবস্থার কিছুই জানিতে পারিল না। এইমাত্র পথে আসিতে আসিতে সে যে সকল সঙ্কল্প মনে মনে ঠিক করিয়াছিল, রমার সম্মুখে বসিয়া তাহার আগাগোড়াই বেঠিক হইয়া গেল। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া, সে কোমলস্বরে জিজ্ঞাসা করিল,—“এখন কেমন আছ রাণি?” রমা তাহার পায়ের গোড়া হইতে একটুখানি সরিয়া বসিয়া কহিল,—“আমাকে আপনি রমা বলেই ডাক্‌বেন।” রমেশের পিঠে কে যেন চাবুকের ঘা মারিল। সে একমুহূর্ত্তেই কঠিন হইয়া কহিল,—“বেশ, তাই। শুনেছিলাম, তুমি অসুস্থ ছিলে—এখন কেমন আছ, তাই জিজ্ঞাসা কর্‌ছিলাম। নইলে, নাম তোমার যাই হৌক্‌, সে ধ’রে ডাক্‌বার আমার ইচ্ছেও নেই, আবশ্যকও হবে না।” রমা সমস্তই বুঝিল। একটুখানি স্থির থাকিয়া ধীরে ধীরে কহিল,—“এখন আমি ভাল আছি।” তার পরে কহিল,—“আমি ডেকে পাঠিয়েছি ব’লে আপনি হয় ত খুব আশ্চর্য্য হয়েচেন, কিন্তু—” রমেশ কথার মাঝ্‌খানেই তীব্র স্বরে বলিয়া উঠিল,—“না, হইনি। তোমার কোনো কাজে আশ্চর্য্য হবার দিন আমার কেটে গেছে। কিন্তু, ডেকে পাঠিয়েছ কেন?” কথাটা রমার বুকে যে কতবড় শেল-আঘাত করিল, তাহা রমেশ জানিতেও পারিল না। সে মৌন-নতমুখে কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া বলিল,—“রমেশ দা’, আজ দু’টি কাজের জন্যে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ডেকে এনেচি। আমি তোমার কাছে কত অপরাধ যে ক’রেচি, সে ত আমি জানি। কিন্তু, তবু আমি নিশ্চয় জান্‌তাম, তুমি আস্‌বে, আর আমার এই দু’টি শেষ অনুরোধও অস্বীকার কর্‌বে না।” অশ্রুভারে সহসা তাহার স্বরভঙ্গ হইয়া গেল। তাহা এতই স্পষ্ট যে, রমেশ টের পাইল, এবং চক্ষের নিমিষে তাহার পূর্ব্বস্নেহ আলোড়িত হইয়া উঠিল। এত আঘাত-প্রতিঘাতেও সে স্নেহ যে আজিও মরে নাই, শুধু নির্জ্জীব, অচৈতন্যের মত পড়িয়াছিল মাত্র, তাহা নিশ্চিত অনুভব করিয়া সে নিজেও আজ বিস্মিত হইয়া গেল। ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া শেষে কহিল,—“কি তোমার আনুরোধ?” রমা চকিতের মত মুখ তুলিয়াই আবার অবনত করিল। কহিল,—“যে বিষয়টা বড়দা’ তোমার সাহায্যে দখল করতে চাচ্চেন, সেটা আমার নিজের; অর্থাৎ আমার পোনর আনা, তোমাদের এক আনা, সেইটাই আমি তোমাকে দিয়ে যেতে চাই।” রমেশ পুনর্ব্বার উষ্ণ হইয়া উঠিল। কহিল,—“তোমার ভয় নেই, আমি চুরি কর্‌তে পূর্ব্বেও কখনো কাউকে সাহায্য করিনি, এখনো কর্‌ব না। আর যদি দান কর্‌তেই চাও—তার জন্যে অন্য লোক আছে—আমি দান-গ্রহণ করিনে।” পূর্ব্বে হইলে রমা তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিত, “মুখুয্যেদের দান-গ্রহণ করায় ঘোষালদের অপমান হয় না।” আজ কিন্তু, এ কথা তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল না। সে বিনীতভাবে কহিল,—“আমি জানি, রমেশ দা’, তুমি চুরি কর্‌তে সাহায্য কর্‌বে না। আর নিলেও যে তুমি নিজের জন্যে নেবে না, সেও আমি জানি। কিন্তু, তা’ত নয়। দোষ কর্‌লে শাস্তি হয়। আমি যত অপরাধ করেচি, এটা তারই জরিমানা ব’লে কেন গ্রহণ কর না!” রমেশ ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল,—“তোমার দ্বিতীয় অনুরোধ?” রমা কহিল,—“আমার যতীনকে আমি তোমার হাতে দিয়ে গেলাম। তাকে তোমার মত ক’রে মানুষ কোরো। বড় হ’য়ে সে যেন তোমার মতই হাসিমুখে স্বার্থত্যাগ কর্‌তে পারে।” রমেশের চিত্তের সমস্ত কঠোরতা বিগলিত হইয়া গেল। রমা আঁচল দিয়া চোখ মুছিয়া কহিল,—“এ আমার চোখে দেখে যাবার সময় হবে না; কিন্তু, আমি নিশ্চয় জানি, যতীনের দেহে তাঁর পূর্ব্বপুরুষের রক্ত আছে। ত্যাগ কর্‌বার যে শক্তি তাঁর অস্থিমজ্জায় মিশিয়ে আছে—শেখালে হয় ত একদিন যে তোমার মতই মাথা উঁচু ক’রে দাঁড়াবে।” রমেশ তৎক্ষণাৎ তাঁহার কোন উত্তর দিল না। জানালার বাহিরে জ্যোৎস্না-প্লাবিত আকাশের পানে চাহিয়া রহিল। তাঁহার মনের ভিতরটা এমন একটা ব্যথায় ভরিয়া উঠিতেছিল, যাহার সহিত কোনদিন তাঁহার পরিচয় ঘটে নাই। বহুক্ষণ নিঃশব্দে কাটার পরে, রমেশ মুখ ফিরাইয়া কহিল,—“দেখ, এ সকলের মধ্যে আর আমাকে টেনো না। আমি অনেক দুঃখ-কষ্টের পর, একটুখানি আলোর শিখা জ্বাল্‌তে পেরেচি;—তাই আমার কেবল ভয়, পাছে একটুতেই তা’ নিবে যায়।” রমা কহিল,—“আর ভয় নেই রমেশ দা’, তোমার এ আলো আর নিব্‌বে না। জ্যাঠাইমা বল্‌ছিলেন, তুমি দূর থেকে এসে বড় উঁচুতে ব’সে কাজ করতে চেয়েছিলে বলেই এত বাধা-বিঘ্ন পেয়েচ। আমরা নিজেদের দুষ্কৃতির ভারে তোমাকে নাবিয়ে এনে এখন ঠিক জায়গাটাতেই প্রতিষ্ঠিত ক’রে দিয়েচি। এখন তুমি আমাদের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েচ বলেই তোমার ভয় হচ্চে; আগে হ’লে এ আশঙ্কা তোমার মনে ঠাঁই পেত না। তখন তুমি গ্রাম্য-সমাজের অতীত ছিলে, আজ তুমি তারই একজন হয়েচ। তাই এ আলো তোমার আর ম্লান হবে না—এখন প্রতিদিনই উজ্জ্বল হ’য়ে উঠ্‌বে।” সহসা জ্যাঠাইমার নামে রমেশ উদ্দীপ্ত হইয়া উঠীল—কহিল,—“ঠিক জানো কি রমা, আমার এই দীপের শিখাটুকু আর নিবে যাবে না?” রমা দৃঢ়কণ্ঠে কহিল,—“ঠিক জানি। যিনি সব জানেন, এ সেই জ্যাঠাইমার কথা। এ কাজ তোমারি। আমার যতীনকে তুমি হাতে তুলে নিয়ে, আমার সকল অপরাধ ক্ষমা ক’রে আজ আশীর্ব্বাদ ক’রে আমাকে বিদায় দাও রমেশদা’, আমি যেন নিশ্চিত হ’য়ে আমার স্বামীর কাছে যেতে পারি।” ব্রজ্রগর্ভ মেঘের মত রমেশের বুকের ভিতরটা ক্ষণে ক্ষণে চমকিয়া উঠিতে লাগিল; কিন্তু, সে মাথা হেঁট করিয়া স্তব্ধ হইইয়া বসিয়া রহিল। রমা কহিল,—“আমার আর একটা কথা তোমাকে রাখতে হবে। বল রাখ্‌বে?” রমেশ মৃদুকন্ঠে কহিল,—“কি কথা?” রমা বলিল,—“আমার কথা নিয়ে বড়দা’র সঙ্গে তুমি কোন দিন ঝগড়া কোরো না।” রমেশ বুঝিতে না পারিয়া প্রশ্ন করিল—“তার মানে?” রমা কহিল,—“মানে যদি কখনও শুন্‌তে পাও, সেদিন শুধু এই কথাটি মনে করো, আমি কেমন ক’রে নিঃশব্দে সহ্য ক’রে চলে গেছি,—একটি কথারও প্রতিবাদ করিনি। একদিন যখন অসহ্য মনে হয়েছিল, সে দিন জ্যাঠাইমা এসে বলেছিলেন,—‘মা, মিথ্যেকে ঘাঁটাঘাঁটি ক’রে জাগিয়ে তুল্‌লেই তার পরমায়ু বেড়ে ওঠে। নিজের অসহিষ্ণুতায় তার আয়ু বাড়িয়ে তোলার মতোন পাপ অল্পই আছে।’ তাঁর এই উপদেশটি মনে রেখে, আমি সকল দুঃখ-দুর্ভাগ্যই কাটিয়ে উঠেচি—এটি তুমিও কোন দিন ভুলো না রমেশ দা’।” রমেশ নীরবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। রমা ক্ষণেক পরে কহিল,—“আজ আমাকে তুমি ক্ষমা কর্‌তে পার্‌চ না মনে ক’রে দুঃখ কোরো না, রমেশ দা’। আমি নিশ্চয় জানি, আজ যা’ কঠিন ব’লে মনে হচ্চে, একদিন তাই সোজা হয়ে যাবে। সেদিন আমার সকল অপরাধ তুমি সহজেই ক্ষমা কর্‌বে জেনে আমার মনের মধ্যে আর কোন ক্লেশ নেই। কা’ল আমি যাচ্চি।”

“কা’ল?” রমেশ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল,—“কোথায় যাবে কা’ল?” রমা কহিল,—“জ্যাঠাইমা যেখানে নিয়ে যাবেন, আমি সেইখানেই যাব।” রমেশ কহিল,—“কিন্তু, তিনি ত আর ফিরে আস্‌বেন না শুন্‌চি।” রমা ধীরে ধীরে বলিল,—“আমিও না। আমিও তোমাদের পায়ে জন্মের মত বিদায় নিচ্চি।” বলিয়া সে হেঁট হইয়া মাটীতে মাথা ঠেকাইল। রমেশ মুহূর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল,—“আচ্ছা, যাও। কিন্তু, কেন বিদায় চাইচ, সেও কি জান্‌তে পার্‌ব না?” রমা মৌন হইয়া রহিল। রমেশ পুনরায় কহিল, “কেন যে তোমার সমস্ত কথাই লুকিয়ে রেখে চ’লে গেলে, সে তুমিই জানো। কিন্তু, আমিও কায়মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, একদিন যেন তোমাকে সর্ব্বান্তঃকরণেই ক্ষমা কর্‌তে পারি। তোমাকে ক্ষমা কর্‌তে না পারায় যে আমার কি ব্যথা, সে শুধু আমার অন্তর্যামীই জানেন।” রমার দুই চোখ বাহিয়া ঝর্‌-ঝর্‌ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। কিন্তু, সেই অত্যন্ত মৃদু-আলোকে রমেশ তাহা দেখিতে পাইল না। রমা নিঃশব্দে দূর হইতে তাহাকে আর একবার প্রণাম করিল, এবং পরক্ষণেই রমেশ ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। পথে চলিতে চলিতে তাহার মনে হইল, তাহার ভবিষ্যৎ, তাহার সমস্ত কাজকর্ম্মের উৎসাহ যেন এক নিমিষে, এই জ্যোৎস্নার মতই অস্পষ্ট-ছায়াময় হইয়া গেছে।

পরদিন সকালবেলায় রমেশ এ বাড়ীতে আসিয়া যখন উপস্থিত হইল, তখন বিশ্বেশ্বরী যাত্রা করিয়া পাল্কীতে প্রবেশ করিয়াছেন। রমেশ দ্বারের কাছে মুখ লইয়া অশ্রু-ব্যাকুলকন্ঠে কহিল,—“কি অপরাধে আমাদের এত শীঘ্র ত্যাগ ক’রে চল্‌লে জ্যাঠাইমা?” বিশ্বেশ্বরী ডানহাত বাড়াইয়া রমেশের মাথায় রাখিয়া বলিলেন,—“অপরাধের কথা ব’ল্‌তে গেলে ত শেষ হবে না বাবা। তায় কাজ নেই।” তাঁর পরে বলিলেন,—“এখানে যদি মরি রমেশ, বেণী আমার মুখে আগুন দেবে। সে হ’লে ত কোনমতেই মুক্তি পাব না। ইহকালটা ত জ্বলে জ্বলেই গেল, বাবা, পাছে পরকালটাও এম্‌নি জ্বলে-পুড়ে মরি, আমি সেই ভয়ে পালাচ্চি রমেশ।” রমেশ বজ্রাহতের মত স্তম্ভিত হইয়া রহিল। আজ এই একটি কথায় সে জ্যাঠাইমার বুকের ভিতরটায় জননীয় জ্বালা যেমন করিয়া দেখিতে পাইল, এমন আর কোন দিন পায় নাই। কিছুক্ষণ স্থির হইয়া থাকিয়া কহিল,—“রমা কেন যাচ্চে জ্যাঠাইমা?” বিশ্বেশ্বরী একটা প্রবল বাষ্পোচ্ছ্বাস যেন সংবরণ করিয়া লইলেন। তার পরে গলা খাটো করিয়া বলিলেন,—“সংসারে তাঁর যে স্থান নেই, বাবা, তাই তাকে ভগবানের পায়ের নীচেই নিয়ে যাচ্চি। সেখানে গিয়েও সে বাঁচে কি না, জানিনে। কিন্তু, যদি বাঁচে, সারা জীবন ধরে এই অত্যন্ত কঠিন প্রশ্নের মীমাংসা কর্‌তে অনুরোধ কর্‌ব, কেন ভগবান্‌ তাকে এত রূপ, এত গুণ, এত বড় একটা প্রাণ দিয়ে সংসারে পাঠিয়েছিলেন এবং কেনই বা বিনা দোষে এই দুঃখের বোঝা মাথায় দিয়ে আবার সংসারের বাইরে ফেলে দিলেন। এ কি অর্থপূর্ণ মঙ্গল অভিপ্রায় তাঁরই, না, এ শুধু আমাদের সমাজের খেয়ালের খেলা। ওরে রমেশ, তাঁর মত দুঃখিনী বুঝি আর পৃথিবীতে নেই।” বলিতে বলিতেই তাঁহার গলা ভাঙ্গিয়া পড়িল। তাঁহাকে এতখানি ব্যাকুলতা প্রকাশ করিতে কেহ কখনও দেখে নাই। রমেশ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। বিশ্বেশ্বরী একটু পরেই কহিলেন,—“কিন্তু, তোর ওপর আমার এই আদেশ রইল রমেশ, তাকে তুই যেন ভুল বুঝিস্‌নে। যাবার সময় আমি কারো বিরুদ্ধে কোন নালিশ ক’রে যেতে চাইনে, শুধু এই কথাটা আমার তুই ভুলেও কখনো অবিশ্বাস করিস্‌নে যে, তার বড় মঙ্গলাকাঙ্ক্ষিণী তোর আর কেউ নেই।” রমেশ বলিতে গেল,—“কিন্তু, জ্যাঠাইমা—” জ্যাঠাইমা তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিলেন,—“এর মধ্যে কোন ‘কিন্তু’ নেই রমেশ। তুই যা’ শুনেছিস্‌ সব মিথ্যে; যা’ জেনেছিস্‌, সব ভুল। কিন্তু, এ অভিযোগের এইখানেই যেন সমাপ্তি হয়। তোর কাজ যেন সমস্ত অন্যায়, সমস্ত হিংসা-বিদ্বেষকে সম্পূর্ণ তুচ্ছ ক’রে চিরদিন এম্‌নি প্রবল হ’য়ে ব’য়ে যেতে পারে, এই তোর ওপর তার শেষ অনুরোধ। এই জন্যই সে মুখ-বুজে সমস্ত সহ্য ক’রে গেছে। প্রাণ দিতে বসেচে, রে রমেশ, তবু কথা কয়নি।” গতরাত্রে রমার নিজের মুখের দুই একটা কথাও রমেশের সেই মুহূর্ত্তে মনে পড়িয়া দুর্জ্জয় রোদনের বেগ যেন ওষ্ঠ পর্য্যন্ত ঠেলিয়া উঠিল। সে তাড়াতাড়ি মুখ নীচু করিয়া প্রাণপণ-শক্তিতে বলিয়া ফেলিল,—“তাকে বোলো জ্যাঠাইমা, তাই হবে।” বলিয়াই হাত বাড়াইয়া কোন মতে তাঁহার পায়ের ধূলা লইয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল!

Continue Reading

উপন্যাস

রক্তে লেখা নাম…
ইমরুল হাসান

Avatar

Published

on

By

হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ালো একদম অপরিচিতা একটি সুন্দরী, রুপবর্তী, লজুক, মিষ্টি মেয়ে, ডানা কাঁটাপরী একদম অপ্সরী। চোঁখে উজ্জ্বল আলোর আভা -প্রতিভার ন্যায় উত্তকণ্ঠা কণ্ঠে বললো! একটু সড়ে দাঁড়াবে আমি জল নিবো।
বলে রাখা ভালো – গ্রামের মসজিদের আজান হচ্ছে আমরা তিন-চার বন্ধু ওজু করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ওজু করছি । আসরের ওয়াক্ত নামাজ পড়ার জন্য। সেই মুহুর্তে অপ্সরীর আগমন । অপরিচিতা মেয়েটি-কে বললাম তুমি আগে নাও- আমি কল চাপ দিচ্ছি। আমি অবকাশ, আমার বন্ধু শরিফ ও ‍রুবেল । ওরা হা করে তাকিয়ে আছে আমার কৃতী দেখে, কেউ কিছুই বলছে না। বোধ হয় ভাবছে । যাইহোক মেয়েটি চেলে গেলে, আমরা তাঁকিয়ে রইলাম পথপ্রাণে তার ছাঁয়া দেখা অব্ধি।
শরিফ: কিরে বেশ মজা নিলি মনে হচ্ছে বেশ চমৎকার মেয়ে আগে তো দেখি নি?
আমি বললাম হয়তো বেড়াতে এসেছে কোথাও!
রুবেল: ধুর বাদ দে! নামাজ পরে চল দূরে কোথাও ঘুরে আসি অনেক সময় বাকি ! ফাগুনের আগুনে যৌবন পাড় না করে প্রকৃতিক ভালোবাসা দিয়ে মুগ্ধ করি নিজেকে।
আমি বলাম চল নামাজের সময় হয়ছে ফালতু কথা বাদ দে।
নামাজ শেষে করে সবাই মেঠো পথে প্রকৃতির সাথে কথা বলতে বলতে সময় পাড় করতে লাগলাম কিন্তু ঐ অপ্সরী রুপবর্তী মেয়ের একটি মুহূর্ত মাথা থেকে সরছে না ! বড্ড ক্লান্ত মনে হচ্ছে নিজেকে অসহায় লাগচ্ছে তচ্ছু ভাবছি সব কিন্তু মন স্থির করতে পারছি না। কেন পারছি না? তার উত্তর ও পাচ্ছি না? তবুও চিন্তায় মনের সন্ধিক্ষনে -মনের আবেশে একাকী তাঁরা-ভরা জ্যোৎস্না রাত মিটিমিটি চাদের আলোর সাথে পার করলাম।
ফজরের নামাজ শেষে -নতুন সূর্যোদয় প্রভাতের আলোয় মৃদ বাতাসে বসে আছি! আমার খুব প্রিয় স্থানে বাঞ্চে ! হঠাৎ দেখে আমি! চমকে উঠি সেই অপরিচিতা অপ্সরী মেয়েটি আস্তে আস্তে গুন গুন করে সুরেলা তরঙ্গে আকাশ বাতাস হৃদয়ের ভালো লাগা দিয়ে সঙ্গীত করছে। আমি একা ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা ভিশন ভয় পাচ্ছিলাম হাত-পা সব অস্থির ভাবে কাপছে কেন কাপছে তা বুঝতে পারছি না? আমি বসে রইলাম চিন্তা করতে লাগলাম কী করবো এখন? কিন্তু সব চিন্তার অবসন ঘটিয়ে মেয়েটি বলো! এই তুমি একা একা কি করছো?
আমি বললাম জ্বী আমাকে বলছো? মেয়েটি জ্বী জনাব তোমাকে > বসে আছি মৃতদের সাথে কথা বলি !
কী তুমি মৃতদের সাথে কথা বলো ! তা কি বলে মৃত মানুষগুলো তোমায় ! ধুর এমনেই দুষ্টমী করলাম । আচ্ছা তুমি কই আসছো? বেড়াতে আসছি ! কাদের বাড়িতে ? বলা যাবে না? কেন বলা যাবে না শুনি? নিশ্চয় বলা যাবে ! আমি ঢাকা ধানমন্ডি থাকি গ্রামের বাড়ি বরিশাল! আন্টির সাথে তোমাদের গ্রামে আসছি । আলী আজম নানার বাড়ি । আমি বললাম ঠিক আছে । ধন্যবাদ । সুন্দর গান গাচ্ছেলে । কণ্ঠও সুন্দর! মানুষ ও সুন্দর ।
অপ্সরী! হ্যাঁ তোমার নামটি তো জানা হলো না । তোমার নাম কি? আমি বললাম: অবকাশ আমার নাম । পড়াশোনা করি এবং ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। হাসছো কেন?
অপ্সরী: হাসবো না জিজ্ঞসা করলাম নাম তুমি দেখি সুমস্ত ডাটা আমাকে দিয়ে দিচ্ছো।
ও আচ্ছা!
অপ্সরী আমি যাই পরে কথা হবে!
আমি বসে রইলাম মৃত মানুষদের সাথে কথা বলার জন্য মৃদ বাতাসে হাওয়াদের সাথে ছন্দ-আনন্দ ও হাজার স্বপ্ন বুকে নিয়ে নিদারুন চিন্তা মাথা ভর্তি শয়তানি।
খুব খুদা লেগেছে! বাড়িতে চলে যেতে হবে হাওয়া খেয়ে জীবন চলবে না শুধু প্রশান্তি পাওয়া যায় মাত্র!
গ্রামের পরিবেশ সস্তি ও প্রশান্তির স্থান তবে কিছুক্ষণ পাইচারি করে বাড়িতে চলে আসলাম। অতঃপর নির্দয় রোদ্রে জহুরের আযান পরছে আমি প্রতিদিন এককলশি আসোনিকমুক্ত জল আনি নামাজ শেষে। আমার সাড়াদিনে মাত্র একটা কাজ! এই একটি কাজ আমাকে আনন্দ দেয়। ভালোবাসা, প্রেম, মায়া ও একবুক ঝালা দিয়েছে নিদারুন ভাবে।
কল চাপদিয়ে জল ভরছি! হয়তো আমাকে দেখে অপ্সরী মেয়েটি আস্তে আস্তে আমার দিকে আসছে কাঁচের একটি ছোট্ট জগ হাতে তাঁর, ভঙ্গিতার সুরে কথা বলে গাঁ আমার খুব জ্বালা ধরে তুবও কিছুই বলা যায় না নিজের শরীর নিয়ন্ত্রণে রাখাই শ্রেয়!
অপ্সরী: ঐ তুমি সব সময় কী এইখানে ঘুর ঘুর কর? আমি হ্যাঁ ! আর কোথায় যাবো ? হতভাগাদের যাওয়ার কোনো জাইগা নেই যে?
অপ্সরী: ওহ আচ্ছা!
আমি: এই তোমার নাম কী তা আমার জানা নেই! যদি বলতে? অপ্সরী: আমার নাম রোজ, কেন? বিলাসী তোমাকে বলে নেই আমার নাম? বলে রাখা ভালো যে বিলাসী আমাদের গ্রামের মেয়ে অপ্সরীর বান্ধবী! কিছুক্ষণ আগেই ওর সাথে কথা বলছি দূর হতে রোজ ঠিক দেখছে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে কলসি নিয়ে চলে আসতে লাগলাম পিছু-ডাক! বললো তুমি আবার কখন আসবে এখানে! আমি: ঠিক বলতে পারছি না কিন্তু আসবো-
মসজিদ ও কবর স্থান এর, পাশেই আসের্নিক মুক্ত -টিউবল স্থানটি খুব সুন্দর। উপরে বকুল ফুল গাছ, পাখিদের কলরব, রোদ্রের কিরোন ঝিকিঝিকি দারুন রোমান্টিক পরিবেশ তৈরি করেছে প্রকৃতিক। মনমুগ্ধ করে আমার স্থানটি পাত্র-কাল ভেদে! খুব মায়, পরম সুঃখ অনুভব করি কিন্তু হঠাৎ একটি মেয়ে কেন এলোমেলো করে দিচ্ছে, সকল প্রশান্তি, ভালো লাগা ভালোবাসা সব কেন? রোজের দিকে ধাবিত হতে লাগচ্ছে! পাশেই দু’টি দিঘি ! দিঘীর চারিপাশে সারিসারি নারকেল বৃক্ষরাজী কদমফুল আর নানা রকম রঙের ফুল গাছ পলাশ-জারুল- কাঁনায়। দিঘী দু’টিতে গাঁয়ের সকল পেশার সকল শ্রেণির মানুষ স্নাণ করে একত্রে হাঁসি-কান্না পাশাপাশি বৈয়ে চলে জীবন সমুদ্র। যৌবন যেন শ্রাবণের প্রবল বৃষ্টিধারা গ্রাস করছে প্রতিদিন- প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে দাঁড়করিয়ে খাদের কিনারে হয়তো এই যাত্রায়।
দিন চলে যায় সন্ধ্যা তারাদের সাথে লুকচুরি করছে চাঁদ জোনাকি পুকাদের সাথে হিসফিসিয়ে কথা বলছে হাওয়া তাদের মধ্যে সুন্দর্যে প্রেমীক-প্রেমীকাদের লাব্যণময় উপমায়াকে হার মানিয়ে প্রকৃতির যেন সাঁঝ সাঁঝ রবরব। নিভু নিভু চাঁদের আলোয় আমি আস্তে আস্তে পথ চলছি! রোজ গান গাইছে, মিষ্টি কণ্ঠে দারুন সুর দারুন প্রতিভা মেয়েটির আমি মুগ্ধ তার প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটা মুহুতে, কিন্তু প্রকাশের দৃঢ় প্রত্যায় দেখাতে পারি না। সাহস সঞ্চয় করতে হবে অনেক! অনন্ধকারে আমায় সে দেখে নি হয়তো বা দেখে থাকলেও রাত হাওয়ার দারুন কথা বলে নি। যাই হোক আমি: বাড়িতে চলে আসলাম কিন্তু কিছুতেই শান্তি লাগচ্ছে না কেন জানি শান্তিগুলো চুপিসারে চলে যাচ্ছে জীবন হতে ক্রমেই! পুকুর পাড়ে সিঁড়িতে আমি আর বন্ধু শরিফ এগারোটা বাজে ঘরির কাঁটায় গল্প করছি। বিস্তারিত বলার পরে শান্তির খোঁজ পেলাম কী করতে হবে বুঝতে পারলাম অভিজ্ঞ লোক বন্ধু আমার। ওরে বিদায় দিয়ে খুব জলদি নিজের রুমে খোঁজ শুরু করলাম অনেক বছর আগে একটি চিরকুট লেখা ছিলো কার তা জানি না তবে আমার কাজে আসবে ঐটা? যথাক্রমে পেলাম আমি পেলাম খুব শান্তি এবং আনন্দ লেখাটি এমন । আমি তোমাকে ভালোবাসি! জরিবলপেন দিয়ে লেখা খুবি চমৎকার কারুকার্র । সাড়াটি রাত ঘুমাতে পারি নি, নিঘুম রাত জোৎস্না ও পাখিদের শব্দে কাটিয়ে দিলাম সুবেসাদি হলো, ক্লান্ত শরীরে ওজু করে নামাজ আদায় করে ঘুমিয়ে পরলাম নিরব সকালে।
ঠিক এগারোটা বাজে শরীফ আমাকে ডেকে ঘুম থেকে উঠালো, তোর তো কোনো খোঁজ খবর নেই? তোকে অনেকই খোঁজ করছে আমার কাছে! রোজ তো যাকে পাচ্ছে তাঁকে তোর কথা জিজ্ঞাস করছে, আমি তো অবাগ কেন?
দু’জনে বুদ্ধি পরামর্ করে ভয়কে জয় করার প্রত্যায় নিয়ে বের হলাম বাড়ি থেকে উপর আলার ভরশা নিয়ে। বড্ড ভীত আমি! কেন কাপচ্ছে সাড়া শরীর নিজেই বুঝতেছি না। বারবার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে! জল খাচ্ছি দু’জনে শরীফ: ভয় পাসনে বাছা- চিন্তা করিস না! রোজ রাজি হয়ে যাবে কিন্তু কীভাবে চিরকুট তাঁকে দেওয়া হবে। বিলাসীকে ডাকবো ? শরীফ: নিজের কাজ নিজে করতে হবে কাউকে বিশ্বাস করিস না।
আমি চিন্তা ভাবনা বেশি না করে এগিয়ে যেতে লাগলাম গন্তব্যেদিকে খুব কাছাকাছি এসে ফিরে আসলাম ব্যার্থার গ্লানী নিয়ে কিন্তু হঠাৎ কেন জানি! পিছু তাকালাম দেখলাম ইশারায় ডাকছে রোজ! হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমার চাইতে আগ্রহ রোজের অনেক বেশি আর কী ভয় কাজ করে প্রেমীক হৃদয়ে ভরা যৌবন ফেরে পেলাম। ইশরাদিয়ে যা বলেছে বুঝতে পরে চিরকুটা একটি কাঠের বঞ্চের নিচে উড়িয়ে দিলাম রোজ দেখে মুচকি হাঁসি দিল কিন্তু কেউ কিছুই বুঝতে পারলো না সেখানে অনেক লোকের আনাগুনা ছিলো। আমি ফিরে এলাম আপন নিড়ে, কি যে আনন্দ মনে সঙ্গপনে বোঝাতে পারবো না। প্রথম প্রেম সফল্যমন্ডীত হতে চলে ছে ….
শরীফ: যাক তুই আজ প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারবি! মনে মনে দোয়া করছি তোর জন্য উপআলা কাছে। যেন একটি সুন্দর মুহূতের স্বাক্ষী হতে পারি, যাক অবশেষে!
বিলাসী আমাকে হন্যহয়ে খোঁজ করছে, কোথাও না পেয়ে বাড়ীতে এসে ডাকছে ভাইয়া ও ভাইয়া! আমি: জ্বী আপু কোনো সমস্যা? না! সমস্যা হয়নি তো, তুই রোজকে যা দিচ্ছিস আমাকে দিতে হবে খুব সুন্দর, লেখা একটি কাগজ আমাকে দে, আমি বললাম এই তুমি বুঝবে না আপু! তোমাকে দেওয়া যাবে না। ঐটা শুধু রোজের জন্য! বিলাসী নাছর বান্ধা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না, ও একটু এড্যানরমাল টাইপের মেয়ে, আমি কিছুই মনে করছি না ওর এসব কথাবাতায়, রাগ করে চলে গেলো আর বলে গেলে আমাকে দিতে হবে না। না দিলে আমি তোর কোনো কথা আর শুনবো না। তোর প্রেম ছুটাচ্ছি, আরো কত কী যে বলতে বলতে চলে গেলো। পাগল একটা ….
ঠিক সন্ধ্যা! মাগরিবের আজান দিচ্ছে, একা একা ওজু করছি! রোজ হয়তো আমার অপেক্ষায় ছিলো? আস্তে আস্তে আসছে আমি অন্যদিকে মনোযোগ দিয়ে আপন মনে নিজের কাজটি করতে লাগলাম কারণ মনের ভিতরে তখন ভয় কাজ করছে। ওজু শেষ করে দাঁড়িয়ে বললাম জল নাও আমি চাপ দিচ্ছি। রোজ : হ্যাঁ ! সাদা একটি টপস ড্রেস ও বুকে উপরে তোয়ালে দিয়া ভীষণ রকম সুন্দর লাগচ্ছে আমি তাঁকিয়ে আছি মুখে কোনো কথা বের হচ্ছে না। কেন কিছু বলতে পারছি না, রোজ বলে উঠলো আমরা আগামী কাল ভোরে ঢাকা চলে যাবো? তুমি ভোরে দেখা করবে? আর তোমার ছবি নিয়ে এসো, তোমাকে মনে পরলে ছবি দেখবো! খুব মনে পরবে তোমাকে, চোঁখের কোণে জল! কাজল ভিজেয়ে গরিয়ে গরিয়ে পরছে চাঁদমুখে থেকে। আমি কষ্টে কিছু বলতে পারলাম না, শুধু সম্মতি দিলাম যা যা বললো। রোজ: অপেক্ষায় থাকবো তোমার! চলে যাওয়া দৃশ্য আমার বড়ই অদ্ভুদ রকমের প্রহাশন দিয়ে যাচ্ছে।
“চলে যাচ্ছে সে, দু’টি কাজল রেখা আখির প্রদীপ জ্বেলে অন্তরে,
বারংবার পিছনে তাকিয়ে ফেলে গছে দীর্ঘশ্বাস!
উজ্জ্বল আলোর লন্ঠন জ্বেলে দিবালকে অরেণ্যর বুকে।
হতাশার হাতছানিতে, ডেকেছিলো অপেক্ষার প্রহর,
আমি অবাগ দৃষ্টিতে সৃষ্টির খোঁজে রইয়েছি বসে।
দু’টি পলক পরে না চোঁখের, ফিরে আসার তাগিদে,
জীন্দালাশ যেন উঁকি মেরে ডালের ফাঁকে!
ফিসফিস শব্দে হারিয়ে যাওয়া প্রকাশ উন্মচোন করে।
একি ডুরে বাঁধা দু’টি প্রাণ, শুধু তীব্র কষ্টে রইয়েছে,
একই পথে আছি তবুও প্রকৃতির কত আপত্তি!
শুধু মন বলে তুমি রোজ! থেকে গেলেই পারতে।
আমি তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে জল প্রান করতে লাগলাম তবুও তৃষ্ণনা মিটে না অস্থির হয়ে গেছে শরীর শুধু ঝাকি দিচ্ছে ভিতর হতে কিছু বুঝতে পারছি না। কি করা উচিৎ আমার, ভাবনাগুলো ক্রমশে গভির থেকে গভির হচ্ছে প্রতিটা মুহুর্তে হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা হচ্ছে প্রচন্ড। নিজ গৃহে এসে জানালা দু’টি খুলে দিয়ে খুব ক্লান্তে দেহ বিছানায় হেলিয়ে দিলাম নিজের অজান্তে অদ্ভুত অনুভূর্তির স্পর্শে গভির পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা পিছু-ডাকছে আমার কল্পনাতে। আস্তে আস্তে রাত গভির হতে লাগলো চারিধারে গহিন অন্ধকারে ডুবে আছে রাত কোথাও কোনো আলো নেই পৃথিবী আজ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে শুধু আমি জেঁগে আছি, একা খুব একাকী। চিন্তারা আমার সঙ্গি রঙ্গিল দিনের অপেক্ষায় একটি মুহুর্তের সুন্দর্যে হাজার রাতের প্রতিক্ষা এখন সর্পদংশন বিষাক্ত বিষ যেন শরীর জুরে প্রকোপ ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেছি কখন!
রোজ: আমার খোঁজ ঠিকই করে গেছে আমি ছিলাম ঘুমের ঘরে! বিলাসিকে একটি নম্বর দিয়ে গেছে টিলিফোনের। বলে গেছে অবকাশ আমার খোঁজ করলে নম্বরটিতে যোগাযোগ করতে বলো। আমার তাকে কিছু দেওয়া হয়নি যন্ত্রনা ছাড়া। যখন ঘুম ভেঙ্গে দেখি সকাল দশটা হতভম্ব হয়ে আবার শুয়ে থাকি নিজেকে নিজের বড্ড মারতে মন চাইছে। কিন্তু তাড়াহুরো করে রোজের খোঁজ করি! কেউ কোথাও নেই পৃথীবি শূণ্য অরণ্যে ঘুরে ঘুরে দিগ্‌ভ্রান্ত আমি! ফিরে আসি পথদিয়ে তখন, বিলাসী পিছু ডাক- ভাইয়া তোমার খবর আছে কিন্তু! তুমি আমাকে ঐ জিনিসটা দিলে না। আমি কিছু বলতে পারলাম না। বিলাসী বললো এটা নাও দেখো তো কি লেখা আছে? আমি নিলাম মনে হলে তাঁকে ফিরে পেলাম খুব পেলাম হুসে ফিরে এলাম আবার সব ভুলে-
বহু দূরে তুমি? কতটা পথ অতিক্রম করে ক্লান্ত হয়ে পৌঁছে গেছো নিজের রাজ্যে? আমি প্রতিক্ষায় রইনু বসে পথের ধারে বটবিক্ষের শীতল ছায়া তলে। খুব ভাবায়, বড়ই চিন্তা হয় কী হবে ভবিসৎ? হবে কী অপেক্ষার প্রহর শেষে? বড্ড ক্লান্তে আর মনের আকুতিতে অবরুদ্ধতা গ্রাস করছে কালো ধুঁয়া বিষণ অনন্দকারে।
প্রায় পনেরো থেকে বিশ দিন অতিক্রম হয়ে গেলে, হঠাৎ একদিন বড় আপুর মোবাইল নিতে পারলাম তার আগেই আমি একটি মোবাইল সিমকার্ড যোগার করছিলাম।
খুব ভয়ে ভয়ে সিমকার্ড পরির্বতন করে, রোজের দেওয়া নম্বরে ফোন করলাম রিং বাজে একবার /দুইবার কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না ফোন। তিনবারে ফোন রিসিভ হলো ও’পাস হতে কে বলছেন? আমি উত্তর দিলাম আমি রোজের ভাই বলছি রোজ কী আছে? খবু ভীত ছিলাম ১৬/১৭ সবে মাত্র বয়স ভীত হাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়, রোজ কে ডেকে ফোন দেওয়া হলো। রোজঃ হ্যালো! ভাইয়া তুমি কেমন আছো? আমি বলাম ভাইয়া না আমি অবকাশ ! তুমি কেমন আছো, রোজঃ তুমি ঢাকায় কবে আসবে? অনেক কথা বলতেছে কিন্তু আমার বিষয় বা সম্পর্কে কোনো কথা নয় বুঝতে পারলাম সেও ভীত ! মানুষের সামনে ভাইয়ার পরিচয় কথা বলছে। যাইহোক ফোনে তখন কুড়ি টাকা ছিলো ৭/৮ মিনিটে শেষ হয়ে গেছে তেমন কোনো কথা হলো না। আমি নিরাশ হয়ে চুপ করে বসে রইলাম । তখন আর আমার পক্ষে কিছুই করার নেই ভেবে আপুকে মোবাইল দিয়ে চলে আসলাম নিজ গৃহে।
শ্রীকান্ত আচার্যের একটি গান শুনতে লাগলাম শুয়ে শুয়ে ,
চৈত্রালী বেলা শেষে কি বলে ছিলো তোমার নয়ন তোমার নয়ন! কখনো দেখি নি আমি আরো কি বলেছিলো তোমার নয়ন তোমার নয়ন। গানগুলো শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পরলাম আমি।

Continue Reading

Trending

error: Content is protected !!